পুরুলিয়ার ছেলে রিক হাজরার মুম্বইয়ে সফল মডেলিং ক্যারিয়ার়।

পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত চেলিয়ামা গ্রামের ছেলে রিক হাজরা নিজের পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসে আজ মুম্বইয়ের ফ্যাশন দুনিয়ায় সাফল্যের আলো ছড়াচ্ছেন। 

গ্রামীণ জীবনের আর্থিক টানাপোড়েন, সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি থেমে যাননি। 

কলকাতার ‘স্টার অফ বেঙ্গল’ ফ্যাশন শো-তে পুরস্কার জিতে ও দেশের বিখ্যাত ভেগা প্রফেশনাল ব্র্যান্ডের ইভেন্টে অংশ নিয়ে রিক আজ হয়ে উঠেছেন পুরুলিয়ার গর্ব। 

তাঁর এই যাত্রা দেখায়, স্বপ্ন যদি বিশ্বাস ও পরিশ্রমের সঙ্গে দেখা যায়, তবে গ্রাম থেকেও মুম্বই পর্যন্ত সাফল্যের পথ তৈরি করা যায়। 🌟


rik hajra purulia

🌟 পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে রিক হাজরার অনুপ্রেরণামূলক মডেলিং সাফল্য

পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে স্বপ্নের শহর মুম্বইয়ে নিজের জায়গা তৈরি করা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। 

কিন্তু চেলিয়ামা গ্রামের ছেলে রিক হাজরা সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছেন। তাঁর জীবন এক অনুপ্রেরণার গল্প, যেখানে রয়েছে পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। 

রঘুনাথপুর ২ নম্বর ব্লকের এই তরুণ ছোটবেলা থেকেই মডেলিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। গ্রামের সরল পরিবেশে বেড়ে ওঠা রিকের স্বপ্ন ছিল ক্যামেরার সামনে নিজের জগৎ গড়ে তোলা। 

কিন্তু বাস্তবের কণ্টকাকীর্ণ পথে হাঁটতে গিয়ে তাঁকে লড়তে হয়েছে নানা বাধার সঙ্গে। 

পরিবারের সীমিত আয়, সুযোগের অভাব, সামাজিক অনুৎসাহ—সবকিছু একত্রে তাঁকে যেন প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নিয়েছে। কিন্তু রিক পিছিয়ে পড়েননি। তিনি নিজের স্বপ্নের প্রতি অবিচল ছিলেন।

রিকের সাফল্য শুরু হয়েছিল যখন তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘স্টার অফ বেঙ্গল’ ফ্যাশন শো-তে অংশ নেন। সেখানেই তাঁর প্রতিভা নজরে আসে বিচারক ও দর্শকদের। 

পরবর্তীতে টলিউড তারকা শুভশ্রী গাঙ্গুলী, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় ও সুস্মিতা দে তাঁকে সম্মান জানান। এই স্বীকৃতিই রিকের আত্মবিশ্বাসকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। 

এরপর তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মুম্বইয়ে, দেশের অন্যতম প্রখ্যাত ‘ভেগা প্রফেশনাল ব্র্যান্ড’-এর এক বিশেষ ইভেন্টে অংশগ্রহণের জন্য। 

পুরুলিয়ার মতো জেলা থেকে উঠে এসে মুম্বইয়ের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থিত হওয়া সত্যিই প্রশংসনীয় এক অর্জন।


🎯 স্বপ্ন দেখা থেকেই শুরু রিকের যাত্রা

রিক হাজরার জীবনের শুরুটা যেমন সাধারণ, তেমনি তাঁর স্বপ্নও ছিল অদ্ভুত রকমের বড়। ছোটবেলায় যখন অনেকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তখন রিক ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন। 

টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন কিংবা ফ্যাশন শো দেখেই তিনি কল্পনা করতেন, একদিন তিনিও সেই আলো ঝলমলে র‍্যাম্পে হাঁটবেন। 

কিন্তু গ্রামের মানুষদের কাছে মডেলিং তখনও এক অচেনা জগৎ। তাই প্রথম দিকে রিককে অনেক তিরস্কার, প্রশ্ন, এমনকি নিরুৎসাহও শুনতে হয়েছে।

তবে সেইসব নেতিবাচক কথাবার্তা তাঁর মনোবল ভাঙতে পারেনি। বরং তিনি আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য। 

পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি শরীরচর্চা, পোশাক নির্বাচন, পোজিং ও ক্যামেরার সামনে অভিব্যক্তি প্রকাশের কৌশল শিখতে শুরু করেন। 

ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়া ও ছোট ছোট স্থানীয় ইভেন্ট ছিল তাঁর শেখার মাধ্যম। দিনরাত এক করে অনুশীলন করেছেন, যাতে সুযোগ এলেই তা কাজে লাগানো যায়। 

রিক বিশ্বাস করতেন, “যে নিজেকে বিশ্বাস করে, তাকে কেউ থামাতে পারে না।” এই বিশ্বাসই তাঁকে একদিন মুম্বইয়ের দরজায় পৌঁছে দেয়।


💪 চ্যালেঞ্জে ভরা পথ, কিন্তু আত্মবিশ্বাস ছিল শক্ত

গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতা কখনো সহজ নয়, বিশেষ করে যখন আপনি এমন এক স্বপ্ন দেখেন যা সমাজের প্রচলিত পথে চলে না। 

রিকের পরিবার আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছল ছিল না। তাঁর বাবা-মা দু’জনই পরিশ্রমী, কিন্তু সংসারের টানাপোড়েনে ছেলেকে শহরে পাঠানো বা প্রশিক্ষণ দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। 

তবুও তাঁরা রিকের স্বপ্নকে বাঁধা দেননি। বরং মানসিকভাবে পাশে থেকেছেন।

রিকের নিজের কথায়, “আমার বাবা-মা হয়তো আর্থিকভাবে আমাকে অনেক সাহায্য করতে পারেননি, কিন্তু আমার স্বপ্নে বিশ্বাস রেখেছিলেন। সেই বিশ্বাসই ছিল আমার শক্তি।” 

গ্রামীণ জীবনের সীমাবদ্ধতা, সুযোগের অভাব, এবং সমাজের সন্দেহভরা দৃষ্টির মাঝেও তিনি নিজের লক্ষ্য থেকে এক ইঞ্চিও সরে আসেননি। প্রতিদিন ছোট ছোট পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়েছেন।

এই যাত্রায় রিকের সামনে একাধিক ব্যর্থতা এসেছিল। অনেক অডিশনে নির্বাচিত হননি, অনেক সময় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেও সুযোগ পাননি। 

কিন্তু তিনি জানতেন, একদিন সঠিক দরজা খুলবেই। তাঁর আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম আর ধৈর্যই শেষ পর্যন্ত তাঁকে মুম্বইয়ে পৌঁছে দেয়।


🏆 সাফল্যের প্রথম ধাপ ও জাতীয় স্বীকৃতি

কলকাতার ‘স্টার অফ বেঙ্গল’ ফ্যাশন শো-ই ছিল রিক হাজরার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। সেখানে তাঁর র‌্যাম্পে হাঁটা, পোশাকের বহন, ও আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি বিচারকদের নজর কাড়ে। 

শুভশ্রী, শ্রাবন্তী ও সুস্মিতা দে’র মতো তারকাদের হাতে পুরস্কার গ্রহণের সেই মুহূর্ত আজও তাঁর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি। সেই পুরস্কারের পর থেকেই তাঁর জীবনে নতুন দরজা খুলতে থাকে।

ভেগা প্রফেশনাল ব্র্যান্ডের ইভেন্টে অংশ নেওয়া তাঁর জন্য এক বিশাল সুযোগ। 

মুম্বইয়ের মতো প্রতিযোগিতাপূর্ণ শহরে নিজের প্রতিভা প্রদর্শন করতে পারা অনেকের স্বপ্ন, আর রিক সেটি অর্জন করেছেন নিজের যোগ্যতায়। 

সেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা প্রতিযোগীদের সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে রিক নিজের আত্মবিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছেন।

এই সাফল্যের মাধ্যমে রিক হাজরা শুধু নিজের নয়, সমগ্র পুরুলিয়া জেলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন। 

তাঁর অর্জন আজ বহু তরুণের অনুপ্রেরণা, যারা ছোট শহর বা গ্রামের মাটি থেকে উঠে এসে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখছে।


👪 পরিবারের গর্ব আর গ্রামের অনুপ্রেরণা

রিক হাজরার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান তাঁর পরিবারের। তাঁর বাবা-মা জানান, “রিক ছোট থেকেই অন্যরকম ছিল। ওর ভেতরে ছিল আলাদা এক আগুন, কিছু করার ইচ্ছা। আজ ওর পরিশ্রম সফল হয়েছে।” 

পরিবারের এই আনন্দের মুহূর্তে গ্রামও গর্বিত। চেলিয়ামা গ্রামের মানুষ এখন রিককে তাদের ‘গর্বের ছেলে’ বলে ডাকে।

গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েরা আজ তাঁকে অনুসরণ করছে। তাঁরা বুঝতে পারছে, বড় শহরে না থাকলেও বড় স্বপ্ন দেখা যায়। 

রিকের গল্প তাদের শেখাচ্ছে—‘নিজের সীমাবদ্ধতা নয়, নিজের সম্ভাবনাকে দেখো।’ তাঁর সাফল্য প্রমাণ করে, একাগ্রতা ও পরিশ্রম থাকলে সমাজের বাধাও একদিন ভেঙে পড়ে।

এই সাফল্যের পরে রিক নিজেই চায় গ্রামের তরুণদের উৎসাহিত করতে। তিনি বলেন, “আমি চাই আমার গল্পে অন্যরা অনুপ্রেরণা পাক। 

গ্রামের ছেলেরা যেন বুঝতে পারে, সুযোগের অপেক্ষা না করে নিজেকে প্রস্তুত করো, কারণ সুযোগ একদিন আসবেই।” 🌱


🚀 ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও রিকের অনুপ্রেরণার বার্তা

রিক হাজরা এখন মুম্বইয়ে বেশ কয়েকটি বড় প্রজেক্টে কাজ করছেন। তাঁর লক্ষ্য ভারতের নামী ব্র্যান্ড ও ফ্যাশন হাউসের সঙ্গে কাজ করা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। কিন্তু সাফল্যের পরও তিনি বিনয়ী। 

বলেন, “আমি কখনও ভুলব না আমি কোথা থেকে এসেছি। পুরুলিয়ার মাটি আমাকে সাহস শিখিয়েছে, সেটাই আমার আসল শক্তি।”

তিনি ভবিষ্যতে একটি মডেলিং প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু করতে চান পুরুলিয়াতেই, যাতে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা শহরে না গিয়েও শিখতে পারে। 

তাঁর বিশ্বাস, সঠিক দিকনির্দেশনা ও অধ্যবসায় থাকলে যেকোনো স্বপ্নই বাস্তব হতে পারে।

রিক হাজরার গল্প কেবল এক তরুণের সাফল্যের কাহিনি নয়, বরং একটি প্রমাণ যে—“স্বপ্ন যদি বিশ্বাস ও পরিশ্রমের সঙ্গে দেখা যায়, তবে সেটি একদিন সত্যি হয়।” 

তাঁর যাত্রা আজ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শেখাচ্ছে, যে অন্ধকার গ্রামেও আলোর স্বপ্ন দেখা যায়, আর সেই আলো একদিন পুরো দেশকে আলোকিত করে তুলতে পারে। 🌟


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url