চিড়কা গৌরীনাথ ধামের ইতিহাস ও আবির্ভাব।

চিড়কা গ্রামের গৌরীনাথ ধামের প্রাচীন গাজন ও চড়ক উৎসব বাংলার দীর্ঘ ঐতিহ্যের পরিচায়ক। 

এই গ্রামে বাবা গৌরীনাথের আবির্ভাবের কাহিনী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে, যেখানে ধার্মিক পরমানন্দ মাহাতের ভক্তি ও নিষ্ঠার গল্প অন্তর্ভুক্ত। 

উৎসবটি শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, বরং গ্রামের সামাজিক বন্ধন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে। 

ব্রাহ্মন জানকী পান্ডে এবং গ্রামের মাহাতদের সহযোগিতায় পূজা আয়োজন হয়, যেখানে প্রথম পাঁঠা বলি ডুংরিয়ার বংশের কুড়মি ছেলে দ্বারা উৎসর্গ করা হয়। 

গাজন উৎসবের সময় গান, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র এবং হস্তশিল্প, খাদ্য বিক্রয়সহ গ্রামের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হয়। 

আজও চিড়কা গাজন উৎসব শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলকে ঐতিহ্য, ভক্তি ও আনন্দের সঙ্গে একত্রিত করে।


chirka gourinath dham

চিড়কা গৌরীনাথ ধামের আবির্ভাব ও প্রাচীন গাজন উৎসব

চিড়কা গ্রামের গাজন ও চড়ক উৎসব বাংলার প্রাচীনতম গ্রামীণ ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ। 

মানভূম তথা বর্তমান পুরুলিয়া জেলার চিড়কা গ্রামে এই উৎসব বহু প্রজন্ম ধরে পালিত হচ্ছে। 

এই গ্রামে প্রাচীন কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষরা বিশেষ ভক্তি ও ধার্মিকতায় বাবা গৌরীনাথকে পূজা করে আসছেন। 

পরমানন্দ মাহাত নামের একজন ধার্মিক কৃষক, যিনি গ্রামের মাহাত ছিলেন, তার বাড়িতেই প্রথম বাবা গৌরীনাথ ধামের আবির্ভাব ঘটে। 

পরমানন্দ বাবু ছিলেন গরু-গাভী পালন ও ধান জমির মালিক, এবং তার পরিবারে বারোমাস বাগাল থাকত। তার গোয়ালের এক কালো সুন্দর গাভী প্রতিদিন এক কুম্ভ দুধ দিত। 

কিন্তু এক সময় দুধ না দেওয়ায় বাগাল সতর্ক হন। তিনি গাভীর পিছুটানে গিয়ে দেখেন গাভীটি একটি ঢেলা গাছে ভর্তি ঝোপঝাড়ে প্রবেশ করে এবং সেখানেই দুধ ঝরে পড়ে। 

এই ঘটনা পরমানন্দ বাবুর কৌতূহল বাড়ায়। তিনি গ্রামের লোকদের সঙ্গে ওই স্থান পরিষ্কার করেন এবং দেখতে পান একটি গোলাকার পাথরের অংশ। পরমানন্দ বাবু ধ্যানে বসেন। 

তিন দিনের মাথায় গভীর রাতে বাবা গৌরীনাথ মানুষরূপে আবির্ভূত হয়ে পরমানন্দ মাহাতকে পূজা করার নির্দেশ দেন। 

তিনি বলেন, ফুল জল দিয়ে নিয়মিত পূজা করলেই তিনি সন্তুষ্ট হবেন। এছাড়া তিনি পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানদেরও পূজায় অংশ নেওয়ার নির্দেশ দেন।

সামাজিক প্রথা ও ব্রাহ্মনের ভূমিকা

চিড়কা গাজন উৎসব শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এটি গ্রামের সামাজিক সংহতির একটি বড় মাধ্যম। 

পরমানন্দ মাহাত সময়মত পূজা করতে না পারায় সমাজের নিয়ম অনুযায়ী আট মৌজার মাহাতরা একত্রিত হন। 

তারা ব্রাহ্মন জানকী পান্ডেকে চিড়কা গ্রামে নিয়ে এসে পূজার আয়োজনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। 

প্রথমে ব্রাহ্মন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে কেবল গৌরীনাথ বাবার নির্দেশে পূজা করা উচিত। 

তবে সেই রাতে তিনি স্বপ্নে বাবা গৌরীনাথকে দেখেন এবং নির্দেশ পান চিড়কা গ্রামে এসে পূজা আয়োজন করতে। পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্মন নিয়মিত পূজায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। 

এই সামাজিক প্রথা নিশ্চিত করেছে যে গাজন উৎসব সব সময় ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে এবং গ্রামের সকল সম্প্রদায় এতে একত্রিত হয়েছে। 

এই ঐতিহ্য গ্রামের যুবক, বৃদ্ধ ও শিশুদের মধ্যে ধার্মিকতা এবং সামাজিক সম্প্রীতি বাড়িয়েছে। 

প্রতিটি পরিবারের সন্তানদের পূজা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং গ্রামের মধ্যে ঐক্য ও বন্ধন দৃঢ় করে।

পূজার আয়োজন ও অর্থনৈতিক প্রভাব

গাজন উৎসবের আয়োজন শুধু ধর্মীয় নয়, এটি চিড়কা গ্রামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকেও সমৃদ্ধ করে। 

উৎসবের সময় গ্রামে হস্তশিল্প, খাদ্য, পণ্য বিক্রয় হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। ব্রাহ্মনেরা পূজার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে আসেন। 

পরমানন্দ মাহাত তাদের ভরণপোষণের জন্য ছয়শ মন ধানের জমি শিবোত্তর হিসেবে দান করেন। এছাড়া পূজায় সহযোগী কামার, নাপিত, ধোবা, ডোম সকলকেও যথাযথ সুবিধা দেওয়া হয়। 

এই ধারা বহু প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। তেল হলুদ বা অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। ব্রাহ্মনেরা মন্দির থেকে পুকুর পর্যন্ত কাঁধে চড়ে যাতায়াত করেন, যা আজও চিড়কা গ্রামের ঐতিহ্য। 

এই উৎসবের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়, সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঐতিহ্য স্থানান্তরিত হয়।

চিড়কা গৌরীনাথ ধামের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

চিড়কা গৌরীনাথ ধাম গ্রামীণ ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। বাবা গৌরীনাথের আবির্ভাব ও আর্শীবাদের কাহিনী গ্রামের মানুষের মধ্যে ভক্তি ও আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। 

গাজন উৎসব শিশু ও যুবকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনা ও ঐতিহ্যের শিক্ষা দেয়। উৎসবের মাধ্যমে স্থানীয় গান, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র এবং বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান চালু থাকে। 

এটি গ্রামের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতিতেও উৎসব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। 

স্থানীয় হস্তশিল্প, পণ্য ও খাদ্য বিক্রয় বৃদ্ধি পায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে চিড়কা গাজন উৎসব গ্রামের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।

বাবা গৌরীনাথের আর্শীবাদ ও বংশপরম্পরা

বাবা গৌরীনাথ পরমানন্দ মাহাতকে ধন্যবাদ দিয়ে তাঁর বংশের সমৃদ্ধি ও শান্তি কামনা করেন। তিনি আর্শীবাদ দেন যে বংশপরম্পরায় তাদের সন্তানরা পূজা করবে। 

প্রথম পাঁঠা বলি উৎসর্গ করা হয় ডুংরিয়ার বংশের কুড়মি ছেলে দ্বারা। পরবর্তী সময়ে, যদি কোনো কারণে বলি দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে গ্রামের অন্য মাহাত বা পাত্ররা বলি উৎসর্গ করতে পারে। 

এই নিয়ম বজায় রেখে আজও চিড়কা গাজন উৎসব পালিত হয়। বাবা গৌরীনাথের আর্শীবাদে ব্রাহ্মনরা ও গ্রামের লোকেরা পূজা-উৎসবের আয়োজন করে। 

এটি প্রমাণ করে যে ধার্মিকতা, সামাজিক সমন্বয় ও ঐতিহ্য একসাথে চলতে পারে।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url