পুরুলিয়ার স্কুলে শিশুদের জন্য ব্যাংক খুলে নতুন দৃষ্টান্ত।

পুরুলিয়ার গেঙ্গাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় আবারও নজর কাড়ল তাদের অনন্য শিক্ষামূলক উদ্যোগে। 

শিশু দিবস উপলক্ষে এখানে চালু হয়েছে কল্পতরু চিলড্রেন্স ব্যাংক এবং শকুন্তলা দেবী গণিত স্বশিক্ষণ কেন্দ্র, যা গ্রামীণ শিক্ষায় নতুন দিশা দেখাচ্ছে। 

এই ব্যাংকের মাধ্যমে শিশুদের ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ের অভ্যাস, দায়িত্ববোধ এবং সমবায় পদ্ধতির ধারণা গড়ে উঠবে। অন্যদিকে গণিত কেন্দ্রটি অঙ্ক শেখাকে আরও আনন্দময় ও সহজ করে তুলবে। 

বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক ও অতিথিরা মনে করছেন—এই উদ্যোগ ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস, নেতৃত্বের মানসিকতা ও বাস্তব শিক্ষার অভিজ্ঞতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। গেঙ্গাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় আজ জেলার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।


purulia school bank

📰 প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খুলে গেল ব্যাংক! পুরুলিয়ায় শিক্ষায় অভিনব উদ্যোগে উচ্ছ্বাস ছড়াল সর্বত্র

পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন উদ্যোগ দেখা যাবে—এটা কয়েক বছর আগেও কেউ ভাবেনি। 

কিন্তু গেঙ্গাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় তাদের ধারাবাহিক উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ করল যে, শিক্ষা শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই প্রকৃত শিক্ষার জন্ম। 

শিশু দিবস উপলক্ষে এই বিদ্যালয়ে উদ্বোধন হলো দুইটি চমকে দেওয়া প্রকল্প— ‘কল্পতরু চিলড্রেন্স ব্যাংক’ এবং ‘শকুন্তলা দেবী গণিত স্বশিক্ষণ কেন্দ্র।’ 

অনুষ্ঠানের দিন স্কুলের ছোট্ট প্রাঙ্গণজুড়ে ছিল রঙিন সাজসজ্জা, ছাত্রছাত্রীদের হাসি, শিক্ষকদের উচ্ছ্বাস, এবং উপস্থিত অতিথিদের প্রশংসার ঢল। 

শিক্ষার পথকে আনন্দময় ও বাস্তবমুখী করতে এই বিদ্যালয় যে কাজ করছে, তা শুধু গ্রামাঞ্চলের জন্য নয়—পুরো জেলার শিক্ষামহলের কাছে অনুকরণীয় উদাহরণ। 

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার চক্রবর্তী জানান যে, এই দুই প্রকল্পের মূলে রয়েছে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করা, তাদের দক্ষতা বাড়ানো, এবং ছোটবেলা থেকেই জীবনচর্চার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো শেখানো। 

এমন উদ্যোগ প্রমাণ করে—গ্রামীণ বিদ্যালয়ও আধুনিক, সৃজনশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শিশুদের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারে।


🌱 গেঙ্গাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্যোগ কেন এত অনন্য?

পুরুলিয়ার গ্রামীণ এলাকার অনেক বিদ্যালয়ই আর্থিক সীমাবদ্ধতা, পরিকাঠামোর ঘাটতি এবং শিক্ষকদের অভাবের মতো সমস্যায় ভোগে। 

সেই তুলনায় গেঙ্গাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় তাদের সৃজনশীলতা, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও দূরদৃষ্টি দিয়ে একের পর এক উদ্যোগে নজর কাড়ছে।

 এর আগে এখানে ‘সোপ ব্যাংক’ চালু করা হয়েছিল, যেখান থেকে শিশুরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব শিখেছে। 

পাশাপাশি ছিল ‘দুঃস্থদের জন্য হাত বাড়াই’ কর্মসূচি, যার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা ছোট ছোট উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজসেবা ও সহানুভূতির পাঠ পেয়েছে। 

এসব প্রকল্পের জোরেই অভিভাবকরা বুঝেছেন, স্কুল শুধু পড়াশোনা শেখায় না—জীবনযাপনের মূল্যবোধও শেখায়।

এই ধারাবাহিক সফলতার প্রেক্ষিতেই এবার শুরু হলো চিলড্রেন্স ব্যাংকগণিত স্বশিক্ষণ কেন্দ্র। 

এই উদ্যোগগুলি শিশুদের ব্যক্তিত্ব বিকাশ এবং শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ। 

গ্রামের মানুষও এটিকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছেন, কারণ এতে তাদের সন্তানরা ছোট থেকেই বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য শিক্ষা পাচ্ছে—হোক তা অর্থনৈতিক সচেতনতা, কিংবা গণিতে মজা নিয়ে শেখার অভ্যাস। 

শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয়, শিক্ষকরাও অনুভব করছেন যে, এমন ধারণাগুলি শিক্ষাকে শুধু ফলাফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছে না, বরং শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনা, আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে তুলছে। 

অনেক শিক্ষাবিদ মনে করছেন, এমন প্রয়াস গ্রামীণ শিক্ষাকে একটি নতুন দিশা দিতে সক্ষম হবে।


🏦 কল্পতরু চিলড্রেন্স ব্যাংক—শিশুদের অর্থনৈতিক শিক্ষার নতুন অধ্যায়

একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যাংক খোলা প্রথমে শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি গভীর চিন্তা-ভাবনার ফল। 

শিশুদের ছোট থেকেই সঞ্চয়, হিসাব রাখা, দায়িত্ববোধ—এই সব বাস্তব জীবনের প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। 

কল্পতরু চিলড্রেন্স ব্যাংক শিশুদের নিজেদেরই উদ্যোগে পরিচালিত হবে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা সামান্য টাকা জমা করবে, নিজেরাই হিসাব রাখবে, এবং নির্দিষ্ট দিনে ব্যাংক পরিচালনায় অংশ নেবে। 

এতে তারা ছোট থেকেই সমবায়ের ধারণা, হিসাববিদ্যার মূলনীতি এবং অর্থ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শিখবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিরা বলেন যে, এই ব্যাংকের মাধ্যমে শিশুরা শুধু অর্থ জমা করতেই শিখবে না—বরং তাদের মধ্যে জন্ম নেবে সংগঠিতভাবে কাজ করার মানসিকতা, নেতৃত্বের গুণ, এবং আগামীর জীবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি অর্থনীতির প্রাথমিক জ্ঞান। 

অনেক সময় গ্রামীণ পরিবারের শিশুরা আর্থিক শিক্ষার সুযোগ পায় না; কিন্তু এই বিদ্যালয় তাদের সেই অভাব পূরণ করছে। 

শিশুদের মধ্যে দেখা গেছে বিশেষ উত্তেজনা—নিজের নামে ছোট্ট টাকা জমা রাখা, নিজের হাতেই এন্ট্রি লেখা, ব্যাংক খোলার দিন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দেওয়া—এসব তাদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। 

ছাত্রছাত্রীরা জানাচ্ছে, এখন তারা বুঝতে পারছে কেন সঞ্চয় প্রয়োজন, কীভাবে টাকা জমালে উপকার হয়, এবং কীভাবে বড় হয়ে তারা আরও দায়িত্ববান হতে পারে। 

এই ব্যাংক প্রকল্প শিশুদের শুধু পড়াশোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছে না—বরং জীবনচর্চার পথও দেখাচ্ছে।


🔢 শকুন্তলা দেবী গণিত স্বশিক্ষণ কেন্দ্র—অঙ্ক শেখা এখন আরও আনন্দদায়ক

‘মানব কম্পিউটার’ নামে বিশ্ববিখ্যাত শকুন্তলা দেবীর নামে এই গণিত স্বশিক্ষণ কেন্দ্র গেঙ্গাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানকে আরও উঁচু স্তরে নিয়ে গেছে। 

অনেক শিশু গণিতে ভয় পায়, অঙ্ককে কঠিন মনে করে, অথবা নিয়মিত অনুশীলন না করায় পিছিয়ে পড়ে। 

এই সমস্যাগুলি কাটিয়ে তাদের গণিতকে ভালোবাসতে শেখানোর উদ্দেশ্যেই এই কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। 

এখানে রয়েছে বিভিন্ন রঙিন চার্ট, গণিতের খেলাভিত্তিক কুইজ, নম্বর কার্ড, সহজ লজিক গেম, এবং মজার পাজল—যেগুলি ব্যবহার করে শিশুদের গণিত শেখানো হবে আনন্দময় পরিবেশে।

শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, এই স্বশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের মতো করে অঙ্ক অনুশীলন করতে পারবে। 

কেউ কোনও অংকে আটকে গেলে শিক্ষকরা নির্দেশনা দেবেন, কিন্তু শেখার মূল মাধ্যম হবে শিশুদের আগ্রহ ও খেলাধুলার মতো কার্যক্রম। 

এতে শিশুদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা বাড়বে, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়বে, এবং দলবদ্ধভাবে কাজ করার অভ্যাস গড়ে উঠবে। 

শকুন্তলা দেবীর অসাধারণ গণিত দক্ষতার উদাহরণ সামনে রেখে ছাত্রছাত্রীরা অনুপ্রাণিত হবে এবং বুঝতে পারবে—অঙ্ক কঠিন নয়, বরং নিয়মিত অনুশীলন করলে অঙ্কও মজার হতে পারে। 

কেন্দ্রটি উদ্বোধনের সময় ছাত্রছাত্রীদের চোখে আনন্দের ঝিলিক ছিল, কারণ তারা বুঝতে পেরেছে—এখন থেকে গণিত হবে খেলার মতো সহজ ও উপভোগ্য।


🎉 শিশু দিবসের অনুষ্ঠানে রঙিন সংস্কৃতি ও আনন্দের ঝলক

উদ্যোগ দুটি উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে শিশু দিবসের দিন অনুষ্ঠিত হলো এক মনোরম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 

বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিজস্ব উদ্যোগে নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, ছোট নাটিকা ও বিভিন্ন প্রদর্শনী প্রস্তুত করে। স্কুলপ্রাঙ্গণ ভরে ওঠে তাদের প্রতিভার রঙে। 

অভিভাবকরা এই অনুষ্ঠান দেখে অভিভূত হন, কারণ এত ছোট বয়সেই তারা নিজেদের দক্ষতা এত সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারে—এটি সত্যিই প্রশংসনীয়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সহ বিদ্যালয় পরিদর্শক সুজয় বসু ও প্রকাশ সরকার, পুরুলিয়া ২ নং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তুষ্ট সহিস, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান হেমন্ত রজক, উজ্জীবন ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অপূর্ব দুবে সহ আরও অনেকে। 

অতিথিরা এই বিদ্যালয়ের সৃজনশীল উদ্যোগ দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। শিক্ষকরাও গর্বের সঙ্গে জানান যে, ছাত্রছাত্রীরা শুধু পড়াশোনায় নয়—সংস্কৃতি, নেতৃত্ব এবং দায়বদ্ধতায়ও সমানভাবে উন্নতি করছে।


🌟 শিক্ষকদের মতে—এই উদ্যোগ বদলে দিচ্ছে শিশুদের চিন্তা-ভাবনা ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি

বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মনে করেন যে এই প্রকল্প দুটি শুধুমাত্র একটি শিক্ষামূলক প্রয়াস নয়, বরং প্রতিটি শিশুর সার্বিক বিকাশের পথ তৈরি করছে। 

চিলড্রেন্স ব্যাংক শিশুদের দায়িত্ববোধ, সঞ্চয়ের অভ্যাস এবং আর্থিক সচেতনতা গড়ে তুলছে। 

অন্যদিকে গণিত স্বশিক্ষণ কেন্দ্র তাদের যুক্তিবোধ, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সৃজনশীল চিন্তাধারাকে আরও প্রসারিত করছে। 

শিক্ষক-শিক্ষিকারা লক্ষ্য করেছেন, এই প্রকল্প শুরুর পর থেকেই ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের প্রতি আগ্রহ ও উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। 

তারা এখন আরও উদ্দীপনা নিয়ে স্কুলে আসছে, নতুন শিখন পদ্ধতি তাদের আকর্ষণ করছে, এবং তারা নিজেদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে।


🌍 পুরুলিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন আলো দেখাল একটি ছোট্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়

গেঙ্গাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্যোগ আজ জেলার গর্বের বিষয়। একটি ছোট গ্রাম, সীমিত পরিকাঠামো, সাধারণ শ্রেণিকক্ষ—তবুও সৃজনশীল চিন্তাধারা, উদ্যম এবং শিক্ষার প্রতি ভালোবাসাই প্রমাণ করে যে পরিবর্তন সম্ভব। 

শিক্ষাবিদদের মতে, গেঙ্গাড়া বিদ্যালয় দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বড় শহরের আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াও প্রয়াস, নিষ্ঠা ও উদ্ভাবনী চিন্তা থাকলে যে কোনো বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে পারে। 

এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে অন্য বিদ্যালয়কেও অনুপ্রাণিত করবে, যা গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url