পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল শহরে রাখার দাবী জোরদার।
পুরুলিয়া সদর হাসপাতালকে শহর থেকে দূরে হাতোয়াড়াতে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্তে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
এই হাসপাতাল বহু বছর ধরে জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত অসংখ্য রোগীর প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
স্থানান্তরের ফলে যাতায়াতের সমস্যা, রাতের নিরাপত্তাহীনতা এবং জরুরি পরিস্থিতিতে রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসক ও নাগরিকেরা।
তারা দাবি তুলেছেন, হাতোয়াড়াতে মেডিক্যাল কলেজ গড়ে উঠুক, কিন্তু পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল শহরেই রাখা হোক যাতে মানুষের চিকিৎসার সুযোগ সহজ ও দ্রুত পাওয়া যায়।
পুরুলিয়া শহরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে অনুষ্ঠিত নাগরিক কনভেনশনে দলমত নির্বিশেষে বহু মানুষ এক কণ্ঠে এই দাবী তুলেছেন।
🏥পুরুলিয়ায় শহরেই সদর হাসপাতাল রাখার দাবিতে জোর আওয়াজ
পুরুলিয়া শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এক গভীর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
সদর হাসপাতালকে শহর থেকে সরিয়ে হাতোয়াড়াতে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত, বহু মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
কারণ এই হাসপাতাল শুধু একটি ভবন নয়, এটি পুরুলিয়া জেলার বিশাল এলাকার মানুষের শেষ ভরসা, শেষ আশ্রয়স্থল।
গ্রাম থেকে ব্লক, ব্লক থেকে শহর — অসংখ্য মানুষের চিকিৎসার আশ্রয় ছিল এই হাসপাতাল।
রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর নির্দেশ জারি করার পরই পুরুলিয়ার মানুষ বুঝতে পারে, শুধু হাসপাতাল সরে যাচ্ছে না, মানুষের বেঁচে থাকার পথটাই সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
এই পরিস্থিতির প্রতিবাদেই সোমবার পুরুলিয়া শহরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয় একটি বিশাল নাগরিক কনভেনশন।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন চিকিৎসক, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ। সবাই একসঙ্গে একটি কণ্ঠে বললেন,
“হাতোয়াড়াতে মেডিক্যাল কলেজ হোক, আমরা তাতে আপত্তি করি না। কিন্তু সদর হাসপাতাল শহরে থাকতেই হবে। না হলে জেলার অসংখ্য মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে।”
এই কনভেনশন প্রমাণ করলো যে এটি দলীয় বা রাজনৈতিক কোনো ইস্যু নয়। এটি মানবিক, মানুষের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রশ্ন।
মানুষের আবেগ, ভয়, অসহায়তা — সবটাই প্রকাশ পেল সভা জুড়ে।
💔 পুরুলিয়ার মানুষ তাদের বাঁচার অধিকার রক্ষা করতে লড়ছে।
🩺 বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা: বাস্তব পরিস্থিতি
পুরুলিয়া জেলার স্বাস্থ্যব্যবস্থা বরাবরই সমস্যার মুখে ছিল। জেলার বিশাল ভৌগলিক বিস্তার এবং গ্রামীণ এলাকা বেশি হওয়ার কারণে ব্লক-স্তরের হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যায় না।
অনেক ব্লক হাসপাতালে ডাক্তার থাকেন না, যন্ত্রপাতি থাকে না, অনেক জায়গায় বেড সংখ্যা অত্যন্ত কম।
মানবাজার এবং ঝালদার মতো মহকুমা থাকলেও সেখানে মহকুমা হাসপাতাল নেই, যা এক বড় সমস্যা।
তাই যে কোনো মাঝারি বা গুরুতর অসুস্থতার ক্ষেত্রে মানুষের প্রথম ও শেষ গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায় পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল।
এখানে শুধু চিকিৎসা নয়, মানুষের মনোবলও জড়িয়ে আছে। রোগী জানে, এখানে চিকিৎসক আছেন, নার্স আছেন, পরিষেবা আছে, জরুরি ব্যবস্থা আছে।
দীর্ঘদিনের বিশ্বাস এখানে গড়ে উঠেছে। তাই এই হাসপাতালকে শহর থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত শুধু চিকিৎসার সমস্যা নয়, মানসিক নিরাপত্তা ভেঙে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত।
যদি সদর হাসপাতাল সম্পূর্ণভাবে হাতোয়াড়াতে চলে যায়, তাহলে শহর থেকে এবং জেলার দূরবর্তী স্থান থেকে আসা রোগীদের অতিরিক্ত ভ্রমণ, সময়, মানসিক চাপ এবং অর্থনৈতিক কষ্ট সহ্য করতে হবে। অনেক সময় এই বাড়তি সময়ই জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য তৈরি করতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রথম ১ ঘণ্টা (Golden Hour) অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময় যদি রাস্তার দেরিতে নষ্ট হয়, রোগী বাঁচানো কঠিন।
তাই মানুষের ভয় যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তব।
🚑 যাতায়াত ও রাতের নিরাপত্তার সংকট
যারা পুরুলিয়া চেনেন তারা জানেন, শহরের তুলনায় হাতোয়াড়া এলাকা বেশ নির্জন এবং রাতের পর যাতায়াত ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে।
কনভেনশনে বক্তারা স্পষ্টভাবে বলেন, সন্ধ্যা নামলেই গাড়ির সংখ্যা কমে যায়, এবং টোটোর ওপর নির্ভর করতে হয়।
কিন্তু টোটো কোনোভাবেই জরুরি রোগী পরিবহনের নিরাপদ যানবাহন নয়। বিশেষ করে রাত ৯টার পর টোটো পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
পাওয়া গেলেও ভাড়া হয় ৪০০-৫০০ টাকা, যা সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে।
রোগীকে নিয়ে হাতোয়াড়ার রাস্তায় যেতে হলে রেললাইন পার হতে হয়, ব্যস্ত বাজার অঞ্চল পার হতে হয়, এবং সংকীর্ণ রাস্তায় যানজট তৈরি হয়। গুরুতর রোগীর ক্ষেত্রে এই সময় নষ্ট হওয়া মানেই জীবন ঝুঁকি।
একজন মা, তাঁর অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কনভেনশনে বলছিলেন:
"আমার ছেলে যদি রাত দুটোয় শ্বাসকষ্টে ভোগে, আমি কিভাবে টোটো পেয়ে তাকে হাতোয়াড়াতে নিয়ে যাব?"
তার প্রশ্নের কোনো উত্তর প্রশাসনের কাছে নেই।
এছাড়া হাতোয়াড়ায় রাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
নার্স, মহিলা ডাক্তার, রোগীর পরিবার — সবার জন্য এটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
স্বাস্থ্য শুধু হাসপাতাল নির্মাণ নয়, যাতায়াত + নিরাপত্তা + জীবনরক্ষা — সব মিলেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
এই তিনটি ক্ষেত্রেই হাতোয়াড়ার প্রস্তুতি এখনও পর্যাপ্ত নয়।
👨⚕️ ডাক্তারদের যুক্তি: “দুটো হাসপাতাল থাকলে সবার লাভ”
চিকিৎসকদের বক্তব্য অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। ডাঃ পার্থ ব্যানার্জী এবং ডাঃ অসীম সিন্হা বলেন, যদি হাতোয়াড়াতে মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়, সেটি জেলার জন্য খুব ভালো উদ্যোগ।
সেখানে নতুন প্রজন্মের ডাক্তার তৈরি হবে, চিকিৎসা পরিসর বাড়বে। কিন্তু এর জন্য শহরের বিদ্যমান সদর হাসপাতাল বন্ধ করা বা সরিয়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
বরং দুটো হাসপাতাল থাকলে জেলার চিকিৎসা পরিষেবা দুই ভাগে বিভক্ত হবে, চাপ কমবে, চিকিৎসকরা কাজ করতে পারবেন আরামভাবে এবং রোগীও পাবেন সঠিক চিকিৎসা।
তারা আরও বলেন, সদর হাসপাতালে ইতিমধ্যেই ভবন, বেড, OT, সাপোর্ট স্টাফ, ওয়ার্ড সুবিধা, ল্যাব সুবিধা সবই আছে।
এগুলো বাদ দিয়ে বড় হাসপাতালকে শূন্য অবস্থায় নতুন স্থানে পাঠানো মানে পরিষেবা ধ্বংস করে দেওয়া।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী:
-
শহরে সদর হাসপাতাল মহকুমা হাসপাতাল হিসেবে চালানো হোক।
-
হাতোয়াড়াতে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গড়ে তোলা হোক।
-
দুই জায়গায় পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ করা হোক।
তারা বলেন:
"স্বাস্থ্য পরিষেবা মানুষের অধিকার। সিদ্ধান্তের আগে মানুষের জীবনকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে।"
🤝 জনগণের ঐক্য: দলমত নির্বিশেষে একসঙ্গে মানুষ
এই কনভেনশনের সবচেয়ে বড় দিক ছিল এখানে কোনো রাজনৈতিক বিভাজন ছিল না। এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাম, ডান, শাসক, বিরোধী — সবাই একই কথা বলেছেন।
কারণ এটি কারও ব্যক্তিগত বা দলের স্বার্থের বিষয় নয় — এটি পুরুলিয়ার প্রতিটি পরিবারের ভবিষ্যৎ।
হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল:
-
"হাসপাতাল সরানো মানে জীবন সরানো"
-
"সদর হাসপাতাল শহরেই থাকবে"
-
"রোগীর জীবন বাঁচাও"
মানুষের চোখে ছিল উদ্বেগ, ভয়, রাগ, এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ বাঁচানোর দৃঢ় সংকল্প।
অনেকে বলছিলেন,
"যদি হাসপাতাল সরানো হয়, তাহলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে নামবো। আমরা আমাদের শহর, আমাদের মানুষের স্বাস্থ্য পরিষেবা বাঁচাব।”
এই ঐক্য প্রমাণ করে, পুরুলিয়া লড়ছে বেঁচে থাকার জন্য।
এক শহর যখন নিজের মানুষের পাশে দাঁড়ায়, সেখানে প্রশাসনেরও দায়িত্ব মানুষের কণ্ঠকে সম্মান করা।
