বিএলও ডিউটির চাপে স্কুলে তালা তাই বিপাকে ছাত্র-ছাত্রীরা।
রাজ্যের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর বুথ লেভেল অফিসার (BLO) এর বাড়তি দায়িত্ব চাপানো হওয়ায় বহু স্কুলে তালা ঝুলছে।
শিক্ষকরা ঘরে ঘরে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ করছেন, ফলে স্কুলে ক্লাস চলছে না, পড়াশোনার ধারাবাহিকতা ভেঙে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামের ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীরা।
তারা শুধু শিক্ষা থেকেই নয়, স্কুলে পাওয়া মিড-ডে-মিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ ও অসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমস্যার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে শিশুদের শিক্ষাগত ও মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই অবিলম্বে বিকল্প ব্যবস্থার দাবি উঠছে।
📰 মিল বন্ধ স্কুলে তালা: বিএলও ডিউটির চাপে সমস্যায় প্রাথমিক শিক্ষা
ভূমিকা
রাজ্যের একের পর এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরজায় এখন তালা ঝুলছে। আগে যেখানে সকালের ঘণ্টা বাজত, ছাত্র-ছাত্রীরা আনন্দে খেলত, মধ্যাহ্নভোজের গন্ধ ভেসে আসত, আজ সেখানে নীরবতা।
গ্রামের রাস্তায় আর সেই স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের দল দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ শুধু একটি — প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বুথ লেভেল অফিসার (BLO) বা ভোটার তালিকা সংশোধনের দায়িত্ব।
এই কাজ করতে গিয়ে বহু শিক্ষক স্কুলে উপস্থিত থাকতে পারছেন না, ফলে স্কুল কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে যেসব বিদ্যালয়ে আগে থেকেই শিক্ষক সংকট ছিল, সেখানে সমস্যা ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
গ্রামের স্কুলগুলো শুধু বই পড়ার জায়গা নয়, গ্রামের শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের কেন্দ্র। অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা স্কুলে এসে শুধু পড়াশোনা নয়, মধ্যাহ্নভোজ খেয়ে পুষ্টি পায়, সহপাঠীদের সাথে সামাজিকতা শিখে, শিক্ষকের সান্নিধ্যে আচরণ গঠিত হয়।
কিন্তু স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের এই সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পড়াশোনা থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিহীনতার আশঙ্কাও বাড়ছে।
অনেক শিশু বাড়িতে পর্যাপ্ত খাবার পায় না, তাই স্কুলের খাবার তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। ফলে এই পরিস্থিতির প্রভাব শুধুমাত্র পড়াশোনায় নয়, শিশুদের শরীর ও মনেও বড় ক্ষতি করছে।
এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি ব্লক বা একটি জেলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। ঝালদা, হুড়া, কাশীপুর, লক্ষণপুর, তুলিন সহ জেলার বহু অঞ্চলে একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে, এবং পরিস্থিতি দিন দিন আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।
যেসব স্কুলে বাস্তবে তালা ঝুলছে?
ঝালদা ব্লকের পুস্তি অঞ্চলের বেদ প্রাথমিক বিদ্যালয় এই সমস্যার অন্যতম বড় উদাহরণ। এখানে দুইজন শিক্ষক রয়েছেন।
তাদের মধ্যে একজন ছুটিতে আর অন্য শিক্ষক মুকেশ মন্ডলকে BLO-র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে বিদ্যালয়ের দরজায় সরাসরি তালা ঝুলে গেছে।
এই স্কুলে বহু শিশুরা পড়াশোনা করে, কিন্তু এই মুহূর্তে তারা সবাই বাড়িতে বসে আছে। তাদের কাছে কেউ পড়ানোর নেই, দেখভালের নেই, আর সবচেয়ে কষ্টের কথা হলো তারা স্কুলের মধ্যাহ্নভোজ খেতেও পারছে না।
তুলিন প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অবস্থাও একই। যদিও নাম বালিকা বিদ্যালয়, এখানে ছেলে-মেয়েরা উভয়েই পড়ে। মোট ৭৮ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে, কিন্তু শিক্ষক মাত্র একজন।
সেই শিক্ষক BLO দায়িত্ব পেয়েছেন, ফলে স্কুল পুরোপুরি বন্ধ। এই ৭৮ জন শিশুর ভবিষ্যত এখন অনিশ্চয়তার মুখে।
কাশীপুর ব্লকের কুমারডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই দৃশ্য। শিক্ষক একজন, ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১৯। শিক্ষক BLO হওয়ায় দরজায় তালা।
কেলিয়াথোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক ২জন—দুজনই BLO। অর্থাৎ স্কুল চালানোর কোনো সুযোগই নেই।
ঠিক একই অবস্থা গড়চড় প্রাথমিক বিদ্যালয়, খারপোড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঢোলকাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
খারপোড়ায় ছাত্র-ছাত্রী ১২০ জন, শিক্ষক ৩ জন—সবাই BLO। মানে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা একবারে থমকে গেছে।
এই উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট, সমস্যা বিচ্ছিন্ন নয়, এটি ব্যাপক। এবং এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে ছোট ছোট শিশুদের ওপর।
সমস্যার মূল কারণ — কেন এই সংকট তৈরি হলো?
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দীর্ঘদিনের সমস্যা হলো শিক্ষক সংকট। বহু স্কুলেই শিক্ষক সংখ্যা খুব কম, কোথাও একজন বা দুইজন শিক্ষকই পুরো বিদ্যালয় পরিচালনা করেন।
তাদের ওপর স্কুল চালানোর পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজ, রক্ষণাবেক্ষণ, ছাত্রছাত্রীদের নথি প্রস্তুত, মিড-ডে-মিল পর্যবেক্ষণ—সবকিছুই থাকে।
এর ওপর আবার BLO-র দায়িত্ব দিলে বোঝা এতটাই বেড়ে যায় যে স্কুল চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
BLO দের কাজ অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। বাড়ি বাড়ি যেতে হয়, ভোটারের তথ্য যাচাই করতে হয়, ফর্ম পূরণ করাতে হয়, বিশেষ করে দূরবর্তী গ্রামগুলোতে এই কাজ আরও কষ্টসাধ্য।
অনেক সময় শিক্ষকদের সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যে ছয়টা পর্যন্ত মাঠে থাকতে হয়। ফলে স্কুলে ক্লাস নেওয়ার সময়ই থাকে না।
তাছাড়া BLO কাজ না করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আশঙ্কা থেকে শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে স্কুল বন্ধ রেখে BLO কাজ করছেন।
এভাবে একদিকে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার বিনিময়ে শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসন যদি বিকল্প ব্যবস্থা না নেয়, তবে শিশুদের শেখার মান এবং বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ মারাত্মকভাবে কমে যাবে।
কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?
এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে গ্রামের অল্পবয়সী ছাত্র-ছাত্রীরা।
তারা এমন এক পর্যায়ে রয়েছে যখন প্রতিদিনের ক্লাস, শিক্ষক-শিক্ষিকার উপস্থিতি, সামাজিক পরিবেশ—সবকিছুই তাদের চরিত্র গঠনে এবং শেখার মান বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।
স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের শেখার ধারাবাহিকতা ভেঙে গেছে। অনেক পরিবারে পড়াশোনার ব্যবস্থা নেই, বই নেই, বাড়িতে কেউ পড়াতে পারে না।
ফলে তারা পড়াশোনা ছেড়ে ধীরে ধীরে অন্য কাজ বা খেলাধুলায় সময় কাটাতে শুরু করছে।
এছাড়া মধ্যাহ্নভোজ বন্ধ থাকায় বহু শিশুর স্বাস্থ্যের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বহু গ্রামীণ অঞ্চলে শিশুরা সঠিক পুষ্টিকর খাবার প্রতিদিন পায় না।
স্কুলের মিড-ডে-মিল তাদের শরীর ও মনের বিকাশের জন্য অপরিহার্য ছিল। এখন সেটিও বন্ধ।
কিছু শিশু দুপুরে ঠিকমতো খেতে না পেরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই অবস্থার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হতে পারে।
সমাধান কী হতে পারত?
অনেক শিক্ষা কর্মী ও অভিভাবকদের দাবি—প্রশাসন BLO-র কাজের জন্য বিশেষ অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করতে পারত।
অথবা, প্রাথমিক স্কুলের বদলে অন্য দপ্তরের কর্মীদের এই কাজে যুক্ত করা যেত। আবার বদলি শিক্ষক পাঠানো বা সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিন পড়াশোনা চালু রাখার ব্যবস্থা করাও সম্ভব ছিল।
কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
শেষ কথা
শিশুরা দেশের ভবিষ্যৎ—এই বাক্য আমরা সবাই জানি। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ আজ তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আছে গ্রামের স্কুলঘরগুলোর সাথে।
শিক্ষা হলো বীজ, আর স্কুল হলো সেই বীজের প্রথম মাটি। যদি সেই মাটি শুকিয়ে যায়, গাছ কী করে বড় হবে?
এখন প্রয়োজন দ্রুত প্রশাসনিক সমাধান, নয়তো এই প্রজন্মের ক্ষতি আর পূরণ করা যাবে না।
