পুরুলিয়ায় ছট উৎসব ২০২৫।
পুরুলিয়ায় ছট উৎসব এখন ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক সর্বজনীন মিলনের প্রতীক। সূর্য দেবতার আরাধনায় জেলার মানুষ ভুলে যাচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতির ভেদাভেদ।
দামোদর নদীর ঘাট থেকে সাহেব বাঁধ পর্যন্ত প্রতিটি প্রান্তে ভক্তিময় পরিবেশ, আলো, সঙ্গীত আর একতার আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রশাসনের নিরাপত্তা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগে নির্বিঘ্নে চলছে এই পবিত্র উৎসব।
চার দিনের ব্রত, অর্ঘ্য ও প্রভাত প্রণামের মাধ্যমে ছট আজ পুরুলিয়ার ঐতিহ্য ও সামাজিক ঐক্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে উঠেছে। 🌞
🌞 পুরুলিয়ায় ছট উৎসবের আলোয় ঐক্যের বার্তা
পুরুলিয়ার মাটিতে ছট উৎসব মানে শুধু ধর্মীয় ভক্তি নয়, এটি মানুষের মিলনের উৎসব। চারদিকে এখন আলোর ঝলক, ভক্তিময় সঙ্গীত, নদীর ঘাটে অর্ঘ্যের থালা আর মুখে হাসির আভা।
একসময় এই উৎসবকে কেবল হিন্দিভাষী মানুষের উৎসব বলে মনে করা হতো, কিন্তু আজ তা আর সীমাবদ্ধ নয়।
পুরুলিয়ার প্রত্যেক প্রান্তে আজ ছট উৎসব পরিণত হয়েছে সর্বজনীন আনন্দের প্রতীকে। শহর থেকে গ্রাম, বাঁধ থেকে নদীর তীর—সবখানেই সূর্য দেবতার আরাধনায় মানুষ একত্রিত হয়েছে।
এই উৎসবের সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো, এটি মানুষকে ধর্ম, ভাষা, ও সংস্কৃতির ভেদাভেদ ভুলে একত্রে আসতে শেখায়।
সূর্য দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে মানুষ যেন নতুন করে জীবনকে ধন্য করে তোলে।
পুরুলিয়ার মানুষ আজ গর্বের সঙ্গে বলছে— “আমরাও ছট পালন করি, আমরাও সূর্যের সন্তান।” এই একতার আবহ পুরুলিয়াকে এক উজ্জ্বল সামাজিক প্রতীকে পরিণত করেছে। 🌅
🌾 সর্বজনীন রূপে ছট উৎসব পুরুলিয়ার সংস্কৃতির অংশ
ছট উৎসব আজ পুরুলিয়ার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আগে যেখানে এই উৎসব বিহার বা উত্তরপ্রদেশের হিন্দিভাষী পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে আজ বাংলাভাষী, সাঁওতালি, কুর্মালি, ও ওড়িয়াভাষী মানুষও সমান উৎসাহে অংশ নিচ্ছেন। এ যেন এক অভূতপূর্ব সামাজিক সংহতির ছবি।
শহর বা গ্রামে, যেখানেই যান না কেন, দেখা যায় একই দৃশ্য—নারীরা রঙিন শাড়িতে সেজে নদীর ঘাটে যাচ্ছেন, হাতে ফল, মিষ্টি ও ঠেকুয়া, পুরুষরা পাশে দাঁড়িয়ে ভক্তিময় সঙ্গীত গাইছেন।
সূর্যাস্তের সময় নদীর জলে প্রতিফলিত আলো যেন মানুষের হৃদয়ে শান্তির বার্তা বয়ে আনে।
পুরুলিয়ার মানুষ এই উৎসবের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়, সমাজে নতুন এক ঐক্যের সূত্র গড়ে তোলে।
শিশুরা আনন্দে মেতে ওঠে, ঘরে ঘরে বাজে মাদল ও ঢোলের তালে তালে। এটি কেবল ভক্তির উৎসব নয়—মানুষের বন্ধন, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার উৎসবও বটে।
🌅 ঘাটে ঘাটে আলো ঝলমল পুরুলিয়ার উৎসবের আবহ
পুরুলিয়ার নিতুড়িয়া, পারবেলিয়া ও রঘুনাথপুর অঞ্চলে ছট উৎসবের দৃশ্য একেবারে বিহারের মতো মনে হয়।
দামোদর নদীর ঘাটে সূর্যোদয়ের আগে থেকেই মানুষ ভিড় জমায়, ভক্তরা মাথায় অর্ঘ্যের ঝুড়ি নিয়ে জলে দাঁড়িয়ে সূর্য দেবতার প্রণাম করেন।
একইভাবে শহরের সাহেব বাঁধে, যা এখন জাতীয় সরোবর হিসেবে গড়ে উঠছে, সেখানে সন্ধ্যা নামতেই মানুষ ভিড় করে সূর্যকে সান্ধ্য অর্ঘ্য দিতে।
নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা, শিশু—সবাই একই আবেগে মেতে ওঠে। কাঁসাই নদীর তীরেও আলো ঝলমলে পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
ঘাটগুলো রঙিন আলোয় সজ্জিত, চারপাশে বাজে ভক্তিমূলক গান, এবং আকাশে উড়ে বেড়ায় উৎসবের আতশবাজির আলো।
পুরুলিয়ার প্রতিটি কোণে এই উৎসবের আবহ মানুষকে মনে করিয়ে দেয়—ভক্তি ও ঐক্যই প্রকৃত শক্তি।
সূর্যের আলো যেমন সবার জন্য সমান, তেমনই এই উৎসবও সবার জন্য খোলা, কোনো ভেদাভেদ নেই। 🌇
🏛️ প্রশাসনের উদ্যোগে নির্বিঘ্ন উৎসব পরিবেশ
এত বিশাল জনসমাগমের উৎসবকে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদভাবে সম্পন্ন করতে পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন ও পুরসভা একসঙ্গে অসাধারণ কাজ করছে।
নিতুড়িয়ার ঘাটগুলিতে রঘুনাথপুর মহকুমা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে চলছে ঘাট পরিস্কার, সুরক্ষা, ও আলো ব্যবস্থার কঠোর তদারকি।
শহরের সাহেব বাঁধ থেকে শুরু করে কাঁসাই নদীর পাড় পর্যন্ত সর্বত্র স্থাপন করা হয়েছে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, পানীয় জল, এবং শৌচাগার।
নারী ব্রতীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মোতায়েন করা হয়েছে মহিলা পুলিশ দলও। পুরুলিয়া পুরসভা ও জেলা পুলিশ প্রশাসন একত্রে কাজ করছে যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।
উৎসবের দিনগুলিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে ঘাটে পৌঁছতে পারেন।
প্রশাসনের এই কার্যকর উদ্যোগে মানুষ নির্ভয়ে উৎসবে অংশ নিচ্ছেন, এবং সামাজিক সম্প্রীতির এই চিত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। 👮♀️
🪔 চার দিনের পবিত্র ছট উৎসবের আচার
ছট উৎসবের বিশেষত্ব হলো এর চার দিনের দীর্ঘ আচার এবং কঠোর ব্রতপালন। প্রথম দিন ‘লাউ-ভাত’ দিয়ে শুরু হয় উৎসবের যাত্রা।
এদিন ব্রতীরা শুদ্ধভাবে রান্না করা লাউ-ভাত খেয়ে শরীর ও মনকে পরিশুদ্ধ করেন। দ্বিতীয় দিন ‘খরনা’—এই দিন সূর্যাস্তের পর কাঠের আগুনে পায়েস তৈরি করা হয়।
ভক্তরা সেই পায়েস খেয়ে উপবাস শুরু করেন। তৃতীয় দিন সান্ধ্যকালীন অর্ঘ্যের দিন, যা উৎসবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
সূর্যাস্তের সময় ব্রতীরা ঠেকুয়া, ফলমূল, ও ডাবের জলে সূর্য দেবতাকে অর্ঘ্য দেন। নদীর জলে তাদের প্রতিবিম্ব যেন ভক্তির এক চিরন্তন প্রতীক।
শেষ দিন ভোরে সূর্যোদয়ের আগে শুরু হয় প্রভাতকালীন অর্ঘ্য, তখন সূর্যের প্রথম কিরণ জলে পড়তেই মানুষ চোখে জল নিয়ে প্রার্থনা করেন।
উপবাস ভঙ্গের সময় ব্রতীদের মুখে থাকে আনন্দ ও শান্তির হাসি—এই দৃশ্য প্রত্যেক মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। 🌅
🕊️ ধর্মীয় আচার নয়, সামাজিক ঐক্যের প্রতীক
আজ ছট উৎসব কেবল ভক্তির উৎসব নয়, এটি সামাজিক সংহতির প্রতীক। পুরুলিয়ার প্রতিটি সমাজ, সম্প্রদায় ও পরিবার আজ একসাথে এই উৎসব পালন করছে।
এখানে ধর্ম, জাতি বা ভাষার বিভাজন নেই; সবাই একসূত্রে বাঁধা সূর্য আরাধনায়। এই উৎসব মানুষকে শেখায় কৃতজ্ঞতা, সহনশীলতা এবং সমান অধিকারের মূল্য।
সূর্য দেবতা সবার জন্য সমান আলো দেন—এই ভাবনা থেকেই ছট উৎসবের আসল অর্থ।
মানুষ নিজের কষ্ট, আশা, প্রার্থনা সব কিছু সূর্যের সামনে উজাড় করে দেয়, যেন নতুন দিনের আলোয় নতুন আশার জন্ম হয়।
পুরুলিয়ার মানুষ এই উৎসবের মাধ্যমে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি নিচ্ছে, সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার বার্তা ছড়াচ্ছে।
এটি এমন এক উৎসব যেখানে ভক্তি মিশে যায় মানবতায়, এবং মানুষের হৃদয় এক হয়ে যায় সূর্যের কিরণে। ☀️
🌍 আধুনিক পুরুলিয়ায় ছটের সাংস্কৃতিক উজ্জ্বলতা
প্রযুক্তির যুগেও ছট উৎসব পুরুলিয়ায় ঐতিহ্যের দীপ্ত উদাহরণ। ঘাটে ঘাটে বাজে ঢাক, নাগাড়া, মাদল; নারীরা লাল-হলুদ শাড়িতে সেজে হাতে ফল ও ফুলের ঝুড়ি নিয়ে প্রার্থনায় দাঁড়ান।
ছোটরা রঙিন পোশাকে আনন্দে দৌড়াচ্ছে, আকাশে উড়ছে রঙিন ফানুস, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ধূপের গন্ধ ও আলো।
এই দৃশ্য কেবল ধর্মীয় নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক উৎসব যেখানে পুরুলিয়ার বহুমুখী ঐতিহ্য মিলেমিশে যায়।
অনেকে ভিডিও ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন, ফলে এই উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশজুড়ে।
পুরুলিয়ার ছট উৎসব এখন দেশের ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে—যেখানে ধর্মের গণ্ডি ভেঙে মানুষ একত্রে দাঁড়াচ্ছে সূর্যের সামনে, প্রার্থনা করছে শান্তি, প্রেম ও সুখের জন্য। 🌈
