মালাবতি মাহাত: পুরুলিয়ার ছৌ শিল্পীর লড়াই থেকে সৌদি আরবের জয়যাত্রা।
পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মালাবতি মাহাত আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে ছৌ নাচের গর্বিত প্রতিনিধি।
এক গৃহবধূ, এক মা, আবার এক সংগ্রামী শিল্পী—তার জীবন যেন এক মহাকাব্য। দারিদ্র্যের অন্ধকার, সমাজের বাঁকা কথা, সংসারের চাপ—কিছুই তাকে থামাতে পারেনি।
শ্বশুর-শাশুড়ির সমর্থন আর স্বামীর নীরব ত্যাগে তিনি গড়ে তুলেছেন ছোট উরমা মহিলা ছৌ একাডেমি।
মহিষাসুরের ভূমিকায় তার নাচ মঞ্চ কাঁপিয়েছে, আর সেই নাচ তাকে পৌঁছে দিয়েছে সৌদি আরবের বৈশ্বিক আসরে।
পুরুলিয়ার ইতিহাসে তিনিই প্রথম মহিলা ছৌ শিল্পী যিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে পারফর্ম করেছেন। তার গল্প আজ অসংখ্য নারীর অনুপ্রেরণা।
মালাবতি মাহাতের সংগ্রাম ও সাফল্যের মহাকাব্য 🌾✨
দারিদ্র্যের অন্ধকারে জন্ম এক আলোকবর্তিকা 🌟
পুরুলিয়ার টাঁইড়ভূমি, যেখানে দারিদ্র্য প্রতিটি মানুষের জীবনে অভিশাপের মতো নেমে আসে, সেই মাটির বুকেই জন্ম নিলেন মালাবতি মাহাত।
জন্ম ২০০০ সালের ৩ আগস্ট, পুরুলিয়ার টামনা থানার অন্তর্গত পাঁড়রাম গ্রামে। বাবা পরমেশ্বর মাহাত ছিলেন দিনমজুর, প্রতিদিন কষ্টের ঘামে সংসারের খরচ চালাতেন।
মা ঊষারানি মাহাত একজন সংগ্রামী নারী, যিনি প্রতিদিন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেও সন্তানদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতেন।
সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী—ছেঁড়া আসন, খালি হাঁড়ি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছিল তাদের প্রতিদিনের গল্প। কিন্তু এই দারিদ্র্য মালাবতির স্বপ্ন থামাতে পারেনি।
তিনি ঝুঁজকা হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। ছোটবেলায় হয়তো জানতেন না একদিন তার নাম ছড়িয়ে পড়বে দেশ-বিদেশে, তবে তার ভেতরে ছিল এক অন্যরকম জেদ, যা তাকে আলাদা করেছিল।
শৈশব থেকেই তিনি অনুভব করতেন, সাধারণ পরিবারের এই কন্যা হয়তো একদিন ভিন্ন কিছু করবেন।
এভাবেই দারিদ্র্যের অন্ধকারের ভেতর জন্ম নিল এক আলোকবর্তিকা, যার আলো একদিন শুধু পুরুলিয়া নয়, সমগ্র বিশ্বকে ছুঁয়ে যাবে।
গৃহবধূ থেকে শিল্পী হয়ে ওঠার প্রথম ডাক 💃❤️
যুবতী বয়সে মালাবতির বিয়ে হয় ছোট উরমা গ্রামের ছৌ শিল্পী সঞ্জয় মাহাতের সঙ্গে। সঞ্জয় নিজেই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এবং একটি দলের নেতৃত্ব দিতেন।
স্বামীর দলের মহড়া দেখেই মালাবতির ভেতরে শিল্পের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ জন্ম নেয়। তিনি ভাবতেন, "আমিও তো নাচতে চাই, আমি কি পারব না?"
কিন্তু তখন তিনি কেবল এক নববধূ, সমাজের চোখে সংসারের দায়িত্বই ছিল তার প্রথম কাজ। এর পাশাপাশি সদ্য মা হওয়ায় সন্তানের লালন-পালনও ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ফলে স্বপ্নগুলো গোপনে বুকের ভেতর চাপা পড়ে থাকত। তবুও আগুন যতই চাপা থাকুক, একসময় তা জ্বলে উঠবেই। প্রতিবেশী কয়েকজন গৃহবধূর সঙ্গে আলোচনা করে সাহস জোগাড় করলেন মালাবতি।
তারা একসঙ্গে পরিকল্পনা করলেন, আমরাও ছৌ নাচ শিখব। অবশেষে একদিন স্বামীকে বললেন, "আমরাও কি নাচতে পারি?"
প্রথমে সঞ্জয় রাজি হননি, কারণ তিনি জানতেন সংসারের কাজের পাশাপাশি এ ধরনের অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন।
কিন্তু স্ত্রীর চোখের জেদ তাকে থামাতে পারল না। অবশেষে মালাবতির ইচ্ছা জিতে যায়, আর শুরু হয় গোপন প্র্যাকটিস। এভাবেই এক গৃহবধূর শিল্পী হয়ে ওঠার প্রথম ডাক বাস্তব রূপ নিতে শুরু করে।
সমাজের বাঁকা কথা আর অবিরাম সংগ্রাম 🥀➡️🌸
যেই না খবর ছড়াল যে কিছু মহিলা ছৌ নাচ শিখছে, গ্রামজুড়ে শুরু হলো বিদ্রুপ আর অপমান।
কেউ বলল—“বউ হয়ে নাচতে যাবে? সমাজ রসাতলে গেল।” কেউ ঠাট্টা করে বলল—“ওদের চরিত্র শেষ।” কেউ কেউ এমনও ভবিষ্যদ্বাণী করল—“এই মেয়েদের আর বিয়ে হবে না।”
সমাজের এই কটূক্তি অনেকের মনোবল ভেঙে দিতে পারত, কিন্তু মালাবতির ক্ষেত্রে তা ঘটল না। বরং তিনি আরো শক্ত হলেন।
শ্বশুর সুধীর মাহাত বৌমার পাশে দাঁড়ালেন, তিনি নিজে শেখানোর কথা বললেন। শাশুড়ি বিলাসী মাহাত স্নেহভরে বুকে টেনে নিলেন এবং বললেন—“লোকের কথায় কান দিস না, নিজের ইচ্ছাটা মারিস না।”
পরিবারের এই অকুণ্ঠ সমর্থন মালাবতিকে ভেতরে ভেতরে ভীষণ শক্তি জোগাল। প্রায় ছয় মাস ধরে প্রতিদিন চলল কঠিন অনুশীলন।
ঘাম, অশ্রু আর রক্ত মিশে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল নতুন এক প্রতিষ্ঠান—‘ছোট উরমা মহিলা ছৌ একাডেমি’।
প্রথমে দলের নাম ছিল ‘সঞ্জয় মাহাত মহিলা ছৌ সমিতি’। আস্তে আস্তে এই দলে যোগ দিলেন বড় বড় শিল্পীরা এবং শুরু হলো এক নতুন যাত্রা। এভাবেই সমাজের বাঁকা কথা আর সংগ্রামের মধ্যেই জন্ম নিল এক নতুন অধ্যায়।
মাতৃত্ব, নাচ আর অবিচল প্রতিজ্ঞা 👩👧➡️🎭
মালাবতির জীবন শুধু নাচেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল মাতৃত্বের দ্বন্দ্বও। একদিকে সন্তান লালন-পালন, সংসারের দায়িত্ব, অন্যদিকে নাচের অনুশীলন—সব একসঙ্গে সামলানো ছিল খুব কঠিন।
প্রথম সন্তানের পর কিছুটা সামলে উঠতে না উঠতেই তিনি আবার মা হলেন দ্বিতীয় সন্তানের। এর ফলে কিছু সময়ের জন্য মঞ্চ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি থামেননি।
সন্তানকে কোলে নিয়ে আবারও অনুশীলনে ফিরলেন। ধীরে ধীরে ফিরে এলেন মঞ্চে।
এবার তিনি দর্শকদের সামনে মহিষাসুরের ভূমিকায় এমন এক নাচ পরিবেশন করলেন, যা দেখে হাততালি থামছিল না।
আসরে যখন তিনি অসুর সেজে প্রবেশ করতেন, দর্শকরা মুহূর্তেই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিল্পকেও তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।
এই দুইয়ের সমন্বয়ে তার জীবন প্রমাণ করেছে—নারী যদি চান, তবে সংসার আর শিল্প একসঙ্গে সামলানো সম্ভব।
দেশ থেকে বিদেশে ছৌ নাচের জয়যাত্রা 🌍💫
মালাবতির নাচ প্রথমে গ্রাম, তারপর জেলা, তারপর রাজ্য ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল দেশের নানা প্রান্তে।
কলকাতার বড় মঞ্চ থেকে দিল্লির রাজপথ, রাঁচির গ্রাম্য আসর থেকে টাটানগর, রামগড়, ধলভূমগড়, বিহার, উড়িষ্যা—প্রতিটি জায়গায় তিনি দর্শকদের মন জয় করেছেন।
একদিন খবর এল—তিনি যাচ্ছেন সৌদি আরব। এ যেন স্বপ্নেরও অতীত। পুরুলিয়ার ইতিহাসে তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি ছৌ নাচ নিয়ে সৌদি আরবে পৌঁছলেন।
বিদেশের মঞ্চে তার অসাধারণ পরিবেশনা দেখে দর্শকরা হাততালি দিতে ভোলেননি।
বিদেশি দর্শকরা বিস্মিত হয়ে দেখলেন, কীভাবে বাংলার গ্রামীণ শিল্প বৈশ্বিক মঞ্চে পৌঁছে যায়।
যেসব মানুষ একসময় কটূক্তি করেছিল, আজ তারাই গর্ব করে বলেন—“ও আমাদের গ্রামের মেয়ে।” এভাবেই মালাবতির নাম গ্রাম ছাড়িয়ে পৌঁছল আন্তর্জাতিক পরিসরে।
স্বামীর ত্যাগ আর সহযাত্রা ❤️
মালাবতির সাফল্যের গল্পে তার স্বামী সঞ্জয় মাহাতের অবদান অমূল্য। তিনি নিজেই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, তার নিজের একটি দলও ছিল।
কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন, মালাবতির ভেতরে যে জেদ, তা কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি সামাজিক বিপ্লব। তাই তিনি নিজের স্বপ্নকে কিছুটা পাশে সরিয়ে রেখে স্ত্রীর সাফল্যের জন্য কাজ করলেন।
স্ত্রীর অনুশীলনে সময় দিলেন, তাকে প্রতিটি পদক্ষেপে সমর্থন করলেন। যদি স্বামী সঞ্জয় মাহাত সমর্থন না করতেন, তবে হয়তো এই ইতিহাস লেখা সম্ভব হতো না।
তার নীরব ত্যাগ, ভালোবাসা আর সমর্থনই মালাবতিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছে। এ যেন এক দম্পতির যৌথ লড়াই, যেখানে একজনের সাফল্য অপরজনের সমর্থনে গড়ে উঠেছে।
সংগ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা 🌟
মালাবতির জীবনকাহিনী শুধু একজন শিল্পীর সাফল্যের গল্প নয়, এটি সংগ্রামের, প্রতিবাদের এবং সমাজকে জবাব দেওয়ার এক অনন্য উদাহরণ।
তিনি প্রমাণ করেছেন—দারিদ্র্য কোনো বাধা নয়, সমাজের বাঁকা কথা কোনো শেকল নয়, নারী হওয়া কোনো অভিশাপ নয়। স্বপ্ন থাকলে, ইচ্ছাশক্তি থাকলে, আর সাহস থাকলে নারীও ইতিহাস লিখতে পারে।
শাশুড়ির সেই কথা—“নিজের ইচ্ছাটা মারিস না”—আজ হাজারো নারীর প্রেরণা হয়ে উঠেছে।
পুরুলিয়ার মাটি থেকে উঠে আসা এই নারী আজ সমগ্র বাংলার গর্ব।
তার নাম শুনলেই ভেসে ওঠে এক গৃহবধূর সংগ্রাম, এক স্বামীর নীরব ত্যাগ, এক পরিবারের সমর্থন আর সমাজকে জবাব দেওয়ার গল্প।
মালাবতি মাহাত প্রমাণ করেছেন, শিল্পই তার শক্তি, শিল্পই তার মুক্তি।