বীরদর্পে সুনিতা মাহাত – মুখোশের আড়ালে এক আলোকরথী নারীর গল্প।
🏆বোঙ্গাবাড়ির মাটির মেয়ে সুনিতা মাহাত ছৌ নাচের মাধ্যমে জয় করেছেন অসংখ্য মানুষের হৃদয় ও ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ যুব পুরস্কার। পড়ুন তাঁর সংগ্রাম, ভালোবাসা ও প্রেরণার অনন্য কাহিনি।
🌟 বীরদর্পে সুনিতা মাহাত – মুখোশের আড়ালে আলো ছড়ানো এক নারীর জীবনগাথা
✍️ কলমে : আজকের পুরুলিয়া
পুরুলিয়ার বোঙ্গাবাড়ি গ্রামের সুনিতা মাহাত ছোটবেলা থেকেই গান-নাচে আগ্রহী ছিলেন। কীর্তন ও ঝুমুর দলে গান গাওয়া থেকেই শুরু, পরে গড়ে তোলেন "মাতাঙ্গিনী হাজরা ছৌ দল"।
মেয়ে হয়ে পুরুষ চরিত্রে ছৌ নাচ শুরু করায় সমাজের কটূক্তি শুনতে হয়, এমনকি মা-ও প্রথমে আপত্তি জানান। কিন্তু বাবা দৃঢ়ভাবে পাশে দাঁড়ান।
বিয়ের পর স্বামী রঞ্জিত মাহাত ও শ্বশুরবাড়ির সবার সমর্থন পান। দুই কন্যার জন্মের পরও নাচ ছাড়েননি।
অসুস্থতা ও বাধা পেরিয়ে ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর পান ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ যুব পুরস্কার।
আজ তিনি গ্রামের অসংখ্য মেয়ের অনুপ্রেরণা, প্রমাণ করেছেন—সংগ্রাম ও সাহস থাকলে স্বপ্ন পূরণ সম্ভব।
🎭 প্রথম আলোর ঝলক – ২০১৭ সালের সেই রাত্রি
📅 তারিখ: ১৬ই এপ্রিল ২০১৭
📍 স্থান: পুরুলিয়ার বোঙ্গাবাড়ি গ্রাম
চড়ক পূজা উপলক্ষে গ্রামজুড়ে উৎসবের আমেজ।
প্রতিটি গলিতে আলো ঝলমল করছে, ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভরে গেছে বাতাস, গ্রামের মেয়েরা পরেছে রঙিন শাড়ি, পুরুষেরা পরেছে নতুন পাঞ্জাবি।
চারদিকে ঢোল, বাঁশি, ধমসার তালে যেন দুলছে বাতাস।
দর্শকদের ভিড় এত বেশি যে মঞ্চের দিকে যাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
হঠাৎ ঢোলের গায়ে কাঠি পড়তেই মঞ্চ যেন কেঁপে উঠল 🥁।
তালে তালে গর্জে উঠল ধমসা, আর মাইকে ভেসে এল গভীর কণ্ঠের সুর—
"প্রথমে বন্দনা করি মূষিকঅ বাহনঅ…" 🎶
দর্শকদের চোখ মঞ্চে স্থির।
তারপর আসরের সামনে এলেন কার্তিকের সাজে এক শিল্পী।
পোশাকের ঝলক, চোখের দৃঢ়তা, বীরোচিত ভঙ্গি—সব মিলিয়ে যেন দেবতাই অবতীর্ণ হয়েছেন।
দর্শকরা হাততালিতে ফেটে পড়লেন 👏।
কেউ শিস দিচ্ছে, কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে, কেউ আবার অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
তখনও কেউ জানে না—এই কার্তিকের সাজে পুরুষ চরিত্রের আড়ালে রয়েছেন এক নারী—সুনিতা মাহাত।
এই মুহূর্ত থেকেই শুরু হল তাঁর আসল যাত্রা।
🌾 মাটির গন্ধে ভেজা শৈশব
বোঙ্গাবাড়ি গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম।
বাবা মুরুলিধর মাহাত, মা চপলা দেবী—কৃষিকাজ করেই সংসার চলে।
ছোটবেলায়ই গান ও নাচের প্রতি তীব্র টান।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই দিদিদের সঙ্গে কীর্তনের দলে গান গাইতেন।
সেই সময় প্রথম মাইক্রোফোন হাতে পাওয়ার অনুভূতি যেন জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল।
পরে গ্রামে গড়ে ওঠে একটি ঝুমুর গানের দল।
প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো গ্রামে প্রোগ্রাম থাকত।
বিয়েবাড়ি, পুজো, মেলা—সব জায়গায় সুনিতা ও তাঁর দলকে দেখা যেত।
☕ চায়ের দোকানে জন্ম নিল নতুন ইতিহাস
একদিন একটি প্রোগ্রাম শেষে ফেরার পথে রাস্তার ধারের একটি চায়ের দোকানে থামল গাড়ি।
সঙ্গে গরম চায়ের কাপ, আড্ডার মাঝে কেউ মজা করে বলল—
"চলো, ছৌ দল করি!" 😄
প্রথমে সবাই হেসে ফেললেও, কথাটি গভীরে গিয়ে লাগল।
মুহূর্তের মধ্যেই সিদ্ধান্ত—দল গঠন হবে, নাম রাখা হবে "মাতাঙ্গিনী হাজরা ছৌ দল"।
সেই দিন থেকেই শুরু হল সুনিতার ছৌ নাচের আসল যাত্রা।
🛡 প্রতিবেশীর কটূক্তি ও বাবার অটল সাপোর্ট
ছৌ নাচ শুরু হতেই গ্রামের মধ্যে গুঞ্জন—
"মেয়ে হয়ে ছৌ নাচ করছে? এর পরে বিয়ে দেবে কে?" 🙄
এই কটূক্তি একদিন মায়ের কানে পৌঁছল।
চপলা দেবী চিন্তায় পড়লেন—সমাজের কথা কি মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেবে?
একদিন তিনি সুনিতাকে আটকেও দিলেন।
কিন্তু বাবার দৃঢ় কণ্ঠ ভেসে এল—
"সন্তানের স্বপ্ন ভাঙা পাপ।" ❤️
তিনি স্ত্রীকে বোঝালেন—"তুমি বাড়িতে থেকো, আমি মেয়েকে মঞ্চে পৌঁছে দেব।"
এই বাবার সমর্থনই সেদিন সুনিতার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখল।
ধীরে ধীরে মা-ও বুঝলেন—এই নাচই তাঁর মেয়ের জীবন।
💍 বিয়ের পর নতুন রূপকথা
বিয়ের সময় সুনিতার মনে সংশয়—নতুন পরিবার নাচ মেনে নেবে তো?
পাত্র রঞ্জিত মাহাত (পুঁড়রু গ্রাম) হাসিমুখে উত্তর দিলেন—
"তুমি আগের মতোই নাচ করবে।" 🌟
সেই মুহূর্তে সুনিতা যেন বাবার মতোই একজন সঙ্গী পেলেন।
শ্বশুর রথু মাহাত ও শাশুড়ি দেবী মাহাত গর্বভরে বৌমাকে গ্রহণ করলেন।
👩👧 মাতৃত্ব ও মঞ্চে ফেরা
দুই কন্যা সন্তানের জন্মের পর কিছুদিন মঞ্চ থেকে দূরে ছিলেন।
কিন্তু শিল্পের প্রতি ভালোবাসা তাঁকে আবার টেনে নিয়ে এল।
শারীরিক অসুস্থতা, ক্লান্তি—সবকিছুর মাঝেও স্বামী রঞ্জিতের একটাই কথা—
"ঢোলের গায়ে কাঠি পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে।" 🥁
প্রতিবারই সেই তালে তাঁর শরীরের সব ব্যথা মিলিয়ে যেত।
🏅 গর্বের মুহূর্ত – ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ যুব পুরস্কার
২২শে নভেম্বর, গত বছর—সুনিতা পেলেন জীবনের অন্যতম বড় সম্মান—
ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ যুব পুরস্কার 🏆।
মঞ্চে পুরস্কার নিতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠেছিল।
মনে পড়ছিল সেইসব দিন—যখন কেউ মায়ের কানে কটূক্তি পৌঁছে দিত, কেউ তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত।
আজ সেই মানুষগুলোই হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন।
🎤 দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ও প্রেরণা
প্রতিটি শো শেষে অনেকেই এসে বলেন—
"আপনার নাচ দেখে বুক ভরে যায়।"
"আপনি আমাদের মেয়েদের জন্য অনুপ্রেরণা।"
কেউ কেউ আবার কাঁদতে কাঁদতে বলেন—
"আপনার মতো মেয়েরা না থাকলে আমাদের সমাজ বদলাবে না।"
এই কথাগুলোই সুনিতার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
💖 মঞ্চ শুধু শিল্পীর নয়, মানুষের মুক্তির জায়গা
সুনিতার বিশ্বাস—
"মঞ্চ শুধু শিল্পীর নয়, মানুষেরও মুক্তির জায়গা।"
তিনি চান গ্রামের মেয়েরা যেন নিজের স্বপ্নকে ভয় না পায়, কুসংস্কারের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসে।
তিনি প্রমাণ করেছেন—যে স্বপ্ন দেখে, তার জীবন বদলায়।
📌 উপসংহার
সুনিতা মাহাতের কাহিনি শুধু একজন শিল্পীর নয়—এটি এক নারীর সাহস, সংগ্রাম ও সাফল্যের ইতিহাস।
-
স্বপ্নপূরণের জন্য জেদ প্রয়োজন 💪
-
পরিবারের সমর্থন হলে অসম্ভবও সম্ভব হয় 🌈
-
প্রতিভা কখনো কুসংস্কারের সামনে হার মানে না 🚫
বোঙ্গাবাড়ির মাটির মেয়ে আজ প্রমাণ করেছেন—
"মুখোশের আড়ালেও আলো থাকে, আর সেই আলোই পথ দেখায়।" ✨