রঘুনাথপুরে তিনদিনের বিশেষ প্রদর্শনী শুরু!

📰রঘুনাথপুরে শুরু হলো “ভারতের মুক্তিসংগ্রামে বাংলা” প্রদর্শনী। জানুন এই অনন্য আয়োজনের উদ্দেশ্য, ইতিহাস ও শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া।


raghunathpur 3 din pradarshoni

📰 রঘুনাথপুরে তিনদিনের বিশেষ প্রদর্শনী শুরু – ইতিহাসের পথে এক অনন্য যাত্রা

📅 রঘুনাথপুর, ২৬ আগস্ট ২০২৫

রঘুনাথপুর মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে শুরু হয়েছে এক অনন্য প্রদর্শনী, যার নাম “ভারতের মুক্তিসংগ্রামে বাংলা”। 

শাঁকড়া হাইস্কুল প্রাঙ্গণে এই প্রদর্শনীকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক আবহ। সকাল থেকেই দেখা গেছে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, স্থানীয় মানুষ ও ইতিহাসপ্রেমীদের ভিড়।

এই আয়োজনের মূল লক্ষ্য কেবল একটি প্রদর্শনী করা নয়, বরং বাংলার গৌরবময় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা। 

স্বাধীনতার ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না থেকে শিক্ষার্থীদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে


প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য

তিনদিনের এই প্রদর্শনী আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবীদের অবদানকে তুলে ধরা এবং নতুন প্রজন্মকে সেই ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করানো। 

আজকের দিনে, যখন প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সময়কে দখল করে নিয়েছে, তখন ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের সংযোগ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই প্রদর্শনী সেই শিকড়ের সঙ্গে আমাদের আবার যুক্ত করে।

তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক সায়ন ঘোষ বলেন:

“শুধু ইতিহাস শেখানো নয়, এই প্রদর্শনীর লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের মনে গর্বের বীজ বপন করা। বাংলার মুক্তিসংগ্রামের গৌরব যেন কেউ ভুলে না যায়।”

এই উদ্যোগের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মনে দেশপ্রেমের চেতনা জাগানোই মূল লক্ষ্য। জাতীয়তাবাদের বীজ যদি কচি মনে বপন করা যায়, তা ভবিষ্যতে একটি দায়িত্বশীল সমাজ গড়ে তুলবে।


উদ্বোধনী দিনের আবহ ও বক্তাদের বক্তব্য

প্রদর্শনীর প্রথম দিনেই সকাল থেকে জমে ওঠে শাঁকড়া হাইস্কুলের প্রাঙ্গণ। উপস্থিত ছিলেন জেলার বিশিষ্ট শিক্ষক, অধ্যাপক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। 

উদ্বোধনের পরই শুরু হয় একটি বিশেষ সেমিনার, যেখানে বক্তারা তুলে ধরেন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন অধ্যায়।

মূল বক্তারা:

  • ড. প্রদীপ কুমার মন্ডল (অধ্যাপক, মানভূম মহাবিদ্যালয়) – তিনি বলেন, “মানভূম শুধু সংস্কৃতির জন্য নয়, সংগ্রামের জন্যও বিখ্যাত। আমাদের অঞ্চলের প্রতিটি মাটির কণায় লুকিয়ে আছে বীরত্বের গল্প।”

  • ড. সুভাষ রায় (সহ-সভাপতি, মানভূম কালচারাল আকাদেমি) – তিনি রঘুনাথপুরের সংগ্রামী ঐতিহ্য তুলে ধরেন এবং বলেন, “এই প্রদর্শনী শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগ।”

ছাত্রছাত্রীদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকে প্রশ্ন করছে, গল্প শুনছে, ছবি তুলছে। সেমিনারে বক্তারা বিপ্লবীদের জীবনের অজানা দিকগুলি তুলে ধরেন, যা শিক্ষার্থীদের মনে গভীর ছাপ ফেলে।


মানভূমের সংগ্রামী ইতিহাসের কাহিনী

বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে মানভূমের ভূমিকা অসাধারণ। এই প্রদর্শনীতে সেই ইতিহাসকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে।

 📖 সিপাহী বিদ্রোহের সময়ের ঘটনা:

  • জয়চণ্ডী পাহাড়ের পাদদেশে কর্ণেল ফস্টারের সেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংদেও।

  • দুর্ভাগ্যবশত, পরাজিত হয়ে তিনি বন্দি হন প্রেসিডেন্সি জেলে, পরে শান্তিপুরে।

  • তাঁর সংগ্রামের বেদনা থেকেই জন্ম নেয় পুরুলিয়ার বিখ্যাত ভাদু গান, যা আজও সেই ইতিহাসকে জীবন্ত করে রেখেছে।

এই কাহিনী কেবল ইতিহাসের পাতা নয়, এটি আমাদের গর্বের সম্পদ। প্রদর্শনীতে এই গল্পের সঙ্গে রাখা হয়েছে দুর্লভ ছবি, দলিলপত্র, যা দেখে দর্শনার্থীরা অভিভূত।


নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছোঁয়া ও অন্নদা চক্রবর্তীর গল্প

রঘুনাথপুরের ইতিহাসে নেতাজির ছোঁয়া এক বিশেষ অধ্যায়। একদিন নেতাজি এসেছিলেন এই অঞ্চল ভ্রমণে। 

তাঁর সঙ্গে ছিলেন অন্নদা চক্রবর্তী, যিনি পরবর্তীতে স্বামী অসীমানন্দ নামে পরিচিত হন। প্রদর্শনীতে নেতাজির এই সফরের স্মৃতিচারণ করা হয়েছে।

গল্পটি এমন— এক অন্ধ ভিক্ষুককে দেখে নেতাজি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। নেতাজির অনুপ্রেরণায় অন্নদা চক্রবর্তী সিদ্ধান্ত নেন কিছু করার। 

বহু বছর পরে সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্রপুর চক্ষু হাসপাতাল, যা আজও মানবসেবার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। 

এই গল্প শুনে শিক্ষার্থীরা বুঝেছে, দেশপ্রেম মানে শুধু যুদ্ধ নয়, মানবতার সেবাও।


শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা

প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস ছিল চরমে। তাদের অনেকেই প্রথমবারের মতো এমন আয়োজন দেখল। একজন ছাত্র বলল:

“যা বইয়ে পড়ি, তা এখানে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে ইতিহাসের ভেতর ঢুকে গেছি।”

শিক্ষকরা মনে করেন, এই ধরনের প্রদর্শনী কেবল বইয়ের জ্ঞান নয়, জীবনের শিক্ষা দেয়। একজন শিক্ষিকা বলেন:

“আমাদের সন্তানদের যদি অতীতের গৌরব জানাতে পারি, তাহলে তারা বর্তমানকে সঠিকভাবে গড়তে পারবে।”


প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ

প্রদর্শনীর প্রতিটি স্টল দর্শনার্থীদের কৌতূহল বাড়িয়েছে। এখানে ছিল:

✔ বিপ্লবীদের বিরল ফটোগ্রাফ। 
✔ স্বাধীনতা সংগ্রামের দলিল ও পুরনো সংবাদপত্রের কাটিং। 
✔ দেশাত্মবোধক গান ও কবিতার প্রদর্শনী। 
✔ মানভূম অঞ্চলের সংগ্রামী ইতিহাস নিয়ে তথ্যচিত্র। 

দর্শনার্থীরা প্রতিটি স্টলের সামনে ভিড় জমাচ্ছিল, ছবি তুলছিল, আলোচনা করছিল। এই অভিজ্ঞতা তাদের মনে নতুন আলো জ্বালিয়েছে।


ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও প্রদর্শনীর বার্তা

তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর জানিয়েছে, এমন প্রদর্শনী শুধু রঘুনাথপুরে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আগামী দিনে জেলার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজেও এটি আয়োজন করা হবে। মূল লক্ষ্য একটাই—

“যেন প্রতিটি শিক্ষার্থী ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং দেশপ্রেমের স্ফুলিঙ্গ তার হৃদয়ে জ্বলে ওঠে।”

এই প্রদর্শনী দেখিয়ে দিয়েছে, ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলা সম্ভব। অতীতকে জানলেই বর্তমানকে সঠিকভাবে গড়া যায়।


শেষকথা: কেন এই আয়োজন স্মরণীয় হয়ে থাকবে

রঘুনাথপুরের এই তিনদিনের প্রদর্শনী শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। 

ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগ, দেশপ্রেমের চেতনা জাগরণ এবং মানবতার বার্তা— সবকিছু মিলিয়ে এই প্রদর্শনী হয়ে উঠেছে অনন্য।

“অতীতের গৌরবকে জানো, ভবিষ্যতের পথ গড়ো।”
এই প্রদর্শনী সেই বার্তাই ছড়িয়ে দিল সবার মধ্যে। 🌟


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url