পুরুলিয়ার টুসু পরব ও মকর মেলা।
২০২৬ সালের জানুয়ারি মাসে পুরুলিয়া জেলায় আয়োজিত টুসু পরব ও মকর মেলার সম্পূর্ণ তালিকা দেখুন। মাঠাবুরু, সতীঘাটা ও দেউলঘাটা সহ বিভিন্ন মেলার তারিখ ও স্থান সম্পর্কে জানুন।
"আইসছে মকর দুদিন সবুর কর"— পুরুলিয়ার লোকগীতিতে এই সুর জানান দিচ্ছে যে সোনালী ধানে চাষির ঘর ভরে উঠেছে, আর তার সাথেই কড়া নাড়ছে জঙ্গলমহলের প্রাণের উৎসব টুসু পরব।
এই কৃষিভিত্তিক উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়। মাঘের হিমেল হাওয়ায় মেলা দেখার আনন্দ, মানুষের উপচে পড়া ভিড় আর স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান এই পরবকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।
মকর সংক্রান্তির পুণ্য লগ্ন থেকে শুরু করে টানা কয়েকদিন ধরে চলে এই আনন্দধারা।
আগামী ১৪ জানুয়ারি ২০২৬ থেকে শুরু হতে চলেছে মকরের মেলা। প্রথম দিনেই পুরুলিয়ার লহরিয়া শিব মন্দির সংলগ্ন মাঠ, বাগমুন্ডির ঠুড়গা জলাধার এবং শিমুলিয়া গ্রামের কাঁসাই নদীর তীরে বসবে বিশাল মেলা।
এছাড়া লালপুরের কাছে শিলাই নদী তীরবর্তী শিলাই মেলা, কুলবাঁধা মেলা, দেউলঘাটা এবং তুলিনের কুল ভাঙা মেলা এই মরসুমের অন্যতম আকর্ষণ। ১৫ জানুয়ারি, অর্থাৎ পয়লা মাঘ থেকে শুরু হয় ‘আখান যাত্রা’।
এই বিশেষ দিনে মাঠাবুরু পাহাড়ের কোলে বসে বিখ্যাত মাঠাবুরু মেলা। খেলাধুলা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে কুশলডি ক্রিকেট ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় বুরু চ্যালেঞ্জার ট্রফি এবং টুসু উৎসব।
পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডের সীমান্তে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে সতীঘাটা মেলা, চাষরোডের খেলাই চন্ডী মেলা এবং ঝালদার বানসা ডুংরি মেলাতেও মানুষের ঢল নামে। পাশাপাশি পাঁচ শহীদের স্মৃতি মেলায় শ্রদ্ধা ও আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
মেলার এই ধারা মাঘের ২ এবং ৩ তারিখেও অব্যাহত থাকে। বাগমুন্ডির নিধিয়াডি গ্রামে কারুরু নদীর কাছে সতীমেলা, বকদ এলাকার সেঁওতি মেলা এবং চড়িদার কাছে ডুঁড়কুড়া মেলা এই অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে।
বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো মাঘের ১৩ দিনের ‘কাঁটা মেলা’, যেখানে ভক্তদের কষ্টসহিষ্ণু আচার ও পিঠা উৎসব দেখা যায়।
জানুয়ারির ২৩ ও ২৪ তারিখে সুইসা কলেজের কাছে নেতাজী সুভাষ মেলা এবং মাঠা পাহাড়ের কোলে দুয়ারসিনি মাঠের মেলা বাংলা ও ঝাড়খন্ডের মানুষের মিলনস্থলে পরিণত হয়।
পুরুলিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা এই মেলাগুলো কেবল উৎসব নয়, বরং মানুষের বেঁচে থাকার রসদ। নদীর চর থেকে পাহাড়ের পাদদেশ— সর্বত্রই এখন সাজ সাজ রব।
আপনিও যদি এই লৌকিক সংস্কৃতির স্বাদ নিতে চান, তবে চলে আসুন লাল মাটির দেশে।
আপনার পরিচিত এলাকার অন্য কোনো মেলার খবর থাকলে অবশ্যই আমাদের জানান, যাতে এই উৎসবের আনন্দ সকলের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। সকলকে মকর ও টুসু পরবের আন্তরিক জোহার।
পুরুলিয়ার টুসু ও মকর মেলা কেবল মেলা নয়, এটি এই অঞ্চলের কৃষি, সংস্কৃতি এবং লৌকিক বিশ্বাসের এক বিশাল মেলবন্ধন।
প্রতিটি মেলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য রয়েছে। নিচে আপনার দেওয়া তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি মেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
১৪ই জানুয়ারি: মকর সংক্রান্তির মেলা
লহরিয়া মেলা: পুরুলিয়া-বাঁকুড়া রাস্তার পাশে লহরিয়া শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে এই মেলা বসে। মকর সংক্রান্তির পুণ্য লগ্নে মানুষ এখানে জলাশয়ে স্নান সেরে মন্দিরে পূজা দেন। এটি স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি স্থান।
ঠুড়গা মেলা: অযোধ্যা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঠুড়গা জলাধারের পাশে এই মেলা বসে। পাহাড়, বন আর নীল জলের মাঝে টুসু গানের সুর এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। এখানে আদিবাসী ও কুড়মি সংস্কৃতির মিলন ঘটে।
শিমুলিয়া মেলা: পুরুলিয়া শহরের খুব কাছে কাঁসাই নদীর চরে এই বিরাট মেলা বসে। মকর স্নান সেরে দলে দলে মানুষ নদীর বালুচরে মেলায় মাতেন। এখানে টুসু প্রতিমা ও রঙিন ‘চৌডল’-এর শোভাযাত্রা দেখার মতো হয়।
শিলাই মেলা: লালপুরের বড় গ্রামে শিলাবতী (শিলাই) নদীর তীরে এই মেলা বসে। লোককথা অনুযায়ী, এই নদীর সাথে জড়িয়ে আছে নানা পৌরাণিক কাহিনী। নদীর তীরে মেলা আর টুসু বিসর্জনের দৃশ্য এখানে অনন্য।
দেউলঘাটা মেলা: আড়শা ব্লকের কাঁসাই নদীর তীরে প্রাচীন দেউলঘাটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাশে এই মেলা বসে। এখানকার দশম-একাদশ শতাব্দীর পোড়ামাটির দেউল বা মন্দিরগুলো ইতিহাসের সাক্ষী। ঐতিহ্যের টানে এখানে বহু মানুষের সমাগম হয়।
কুলবাঁধা ও কুল ভাঙা মেলা: বাগমুন্ডি ও তুলিন অঞ্চলে এই মেলাগুলো মূলত সামাজিক মিলন মেলা। মকরের পিঠা-পুলি খেয়ে গ্রামের মানুষ মেলায় গিয়ে আনন্দ ভাগ করে নেন।
১৫ই জানুয়ারি: পয়লা মাঘ (আখান যাত্রা)
মাঠাবুরু মেলা: পুরুলিয়ার অন্যতম বিখ্যাত ও প্রাচীন মেলা। আখান যাত্রার দিন ভোরবেলা থেকে মানুষ মাঠাবুরু পাহাড়ের মাথায় ওঠেন। পাহাড়ের দেবতার আশীর্বাদ নিতে ও মেলার আনন্দ উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে ভিড় জমান।
কুশলডি মেলা: ঝালদা এলাকায় কুশলডি ময়দানে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনালের সাথে টুসু মেলার আয়োজন করা হয়। আধুনিক খেলাধুলা আর লোক-সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন দেখা যায় এখানে।
সতীঘাটা মেলা: ঝালদা ২ নং ব্লকে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডের সীমান্তে এই মেলা বসে। দুই রাজ্যের মানুষের মিলনস্থলে পরিণত হয় এই মেলাটি।
বানসা ও মুরি ডুংরি মেলা: পাহাড়ের (ডুংরি) ওপর এই মেলাগুলো বসে। বানসা ডুংরির ওপরে একটি প্রাচীন কুয়োর মাহাত্ম্য আছে। মানুষ পাহাড় চড়ার রোমাঞ্চ আর মেলার আনন্দ একসাথে উপভোগ করেন।
পাঁচ শহীদ মেলা: এটি মূলত একটি স্মারক মেলা। স্বাধীনতার লড়াইয়ে শহীদ হওয়া গোকুল মাহাতো, গণেশ মাহাতোসহ পাঁচ বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই মেলার আয়োজন করা হয়।
১৬-১৭ই জানুয়ারি ও পরবর্তী মেলা
সতীমেলা (বাগমুন্ডি): কারুরু নদীর তীরে বাগমুন্ডির এই মেলাটি অত্যন্ত আবেগপূর্ণ। সতীদাহ প্রথা বা স্থানীয় কোনো মহিয়সী নারীর আত্মত্যাগের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে এই মেলা গড়ে উঠেছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
ডুঁড়কুড়া মেলা (চড়িদা): ছৌ নাচের মাস্ক তৈরির গ্রাম চড়িদার কাছে এই মেলা বসে। এখানে লোকশিল্পীদের সমাগম ঘটে এবং টুসু গান ও ঝুমুর নাচের আসর বসে।
কাঁটা মেলা (১৩ই মাঘ): এটি একটি অত্যন্ত রোমাঞ্চকর মেলা। এখানে ভক্তরা কাঁটার ওপর গড়াগড়ি দিয়ে তাদের ভক্তি প্রদর্শন করেন। মাঘ মাসের এই বিশেষ দিনে হাতে পিঠা ছাঁকা বা আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটার মতো আচারও দেখা যায়।
নেতাজী সুভাষ মেলা (সুইসা): ২৩শে জানুয়ারি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিন উপলক্ষে সুইসা ও দুয়ারসিনি মাঠে এই মেলা বসে। এটি মূলত একটি জাতীয়তাবাদী চেতনার সাথে লোক-সংস্কৃতির মিলন উৎসব।
পুরুলিয়ার এই মেলাগুলো কেবল কেনাবেচার জায়গা নয়, বরং এগুলো আমাদের শেকড়ের টান আর বেঁচে থাকার উৎসব।
টুসু গানের কলি আর মাদলের আওয়াজে যে সম্প্রীতির সুর ধ্বনিত হয়, তা যেন সারা বছরের সমস্ত ক্লানি মুছে দেয়।
লাল মাটির ধুলো উড়িয়ে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ যখন মেলাপ্রাঙ্গণে এসে মিলিত হন, তখন ধর্ম-বর্ণের বিভেদ ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে মানুষের আপন পরিচয়।
সোনালী ধানের গন্ধে ভরা এই উৎসবের মরসুমে পুরুলিয়ার এই ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোতে আপনিও আমন্ত্রিত। আসুন, মেতে উঠুন শিকড়ের টানে আয়োজিত এই লোক-সংস্কৃতির মহা-মিলন মেলায়।
আপনার পদধূলি আর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই মেলাগুলোকে আরও সার্থক এবং প্রাণবন্ত করে তুলবে। সকলকে আবারও জানাই মকর সংক্রান্তি ও টুসু পরবের আগাম শুভেচ্ছা ও আন্তরিক জোহার।
