পুরুলিয়ার প্রতিমাশিল্পীর জীবন মহাজনের ঋণে বন্দি।
পুরুলিয়ার প্রতিমাশিল্পীরা প্রতিটি দুর্গাপুজোতে মা দুর্গার প্রতিমা গড়েন, কিন্তু মহাজনের ঋণের বোঝা তাদের জীবনের আনন্দকে সীমিত করে।
তিন প্রজন্মের শিল্পী পরিবার ফকির পাল, রাজীব পাল ও নাতি শুভদীপের সংগ্রাম দেখায় কীভাবে ঐতিহ্য রক্ষা করতে গিয়ে অর্থের চাপে জীবন বন্দি থাকে।
প্রতিমা তৈরিতে রাতদিন পরিশ্রম, উপকরণ ক্রয় ও শ্রমিকদের মজুরি—সব মিলিয়ে আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পায়।
দর্শক মুগ্ধ হয়, প্যান্ডাল আলোছটা উপভোগ করে, কিন্তু শিল্পীর পরিশ্রম ও দুঃখ অগোচর থাকে। এই গল্প শুধু দুর্গাপুজোর আনন্দ নয়; এটি ঐতিহ্য, শিল্প, পরিবার এবং আর্থিক বাস্তবতার মিলিত সংগ্রামের গল্প।
জগজ্জননীকে প্রাণ দেওয়া শিল্পীর জীবন মহাজনের ঋণের ফাঁদে বন্দি
পুরুলিয়ার রথতলা, মণিহারা ও কাশিপুরের দুর্গাপুজোর সময় শহর পুরোপুরি আলোর ঝলকানি, সঙ্গীত আর উৎসবের আনন্দে ভরে ওঠে।
প্রতিটি প্যান্ডালে মা দুর্গার রূপ ফুটে ওঠে বাঁশ, খড়, মাটি, রঙ এবং শোলার সাজের সমন্বয়ে। দর্শক ভিড় জমায়, গান বাজে, আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে শহরের প্রতিটি কোণে।
কিন্তু এই আনন্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকে প্রতিমাশিল্পীর দীর্ঘ সংগ্রাম এবং জীবনের কঠিন বাস্তবতা। ফকির পাল, ৬৭ বছরের প্রবীণ প্রতিমাশিল্পী, সারাজীবন মা দুর্গার প্রতিমা তৈরি করেছেন।
তাঁর ছেলে রাজীব পাল এবং নাতি শুভদীপ—তিন প্রজন্ম একই ছাউনির নিচে কাজ করে মা দুর্গার প্রতিমা গড়ছেন। কিন্তু প্রতিটি প্রতিমার পেছনে লুকিয়ে থাকে আর্থিক চাপ।
প্রতিটি বছর প্রতিমা তৈরি করতে কাঠ, খড়, মাটি এবং সাজসজ্জা কিনতে হয় প্রায় ৬৫-৭০ হাজার টাকা।
শ্রমিকদের মজুরি যোগ করলে প্রয়োজন হয় লাখ টাকারও বেশি। এত টাকা স্বল্পবিত্ত পরিবারগুলোর কাছে সহজলভ্য নয়।
তাই মহাজনের কাছে ধার নিতে হয়। ঋণ শোধের সময় সুদের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রতিমা বিক্রি হওয়ার পর কিছুটা টাকা হাতে আসে, কিন্তু তার বড় অংশ চলে যায় ঋণ পরিশোধে।
শেষ পর্যন্ত হাতে থাকে সামান্য লাভ। ফকির পাল বলেন, “মা দুর্গা আসেন, কিন্তু ঋণমুক্তির আশীর্বাদ দেন না। প্রতিবারই খাতার বোঝা আরও ভারী হয়।”
তিন প্রজন্মের শিল্পীর সংগ্রাম
রাজীব পাল বলেন, “বরাত মিললেও অনেকগুলোই ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। কারণ পুঁজি নেই। এবছর যা বর্ষা! প্রতিমা শুকোতোও না। কাজও আটকে যেত।”
এই পরিবারটি শুধু একার নয়; পুরো রথতলা, মণিহারা ও কাশিপুরের প্রতিমাশিল্পীদের অনেকেই একই চক্রে আবদ্ধ। প্রতিমা তৈরি, ঋণ, সুদ, বিক্রয়—এই চক্র বছরের পর বছর চলতে থাকে।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শুভদীপ বলেন, “আমি দাদুর কাছ থেকে শিখছি। খুব ভালো লাগে। কিন্তু দাদুর কষ্ট দেখে ভয়ও হয়। ভবিষ্যতে হয়তো অন্য কিছু করতে হবে।”
তার কণ্ঠে ধরা পড়ে দ্বন্দ্ব—ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বপ্ন, আর বাস্তব জীবনের কঠিন বাস্তবতা। এই তিন প্রজন্মের পরিবার প্রতিমা তৈরিতে যতটা আনন্দ পান, তার চেয়েও বেশি উদ্বেগের মুখোমুখি হন।
ঋণের বোঝা, পুঁজি নেই, বরাত মিললেও তা সীমিত—এই সব কারণে প্রতিমা তৈরির আনন্দে মিশে থাকে ভয়, দুশ্চিন্তা এবং অনিশ্চয়তা।
প্রতিমাশিল্পীর জীবনে প্রতিটি বছর এক নতুন পরীক্ষা; প্রতিমা গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ কিনতে হয়, শ্রমিকদের মজুরি দিতে হয় এবং তারপরও অর্থনীতি যথেষ্ট থাকে না।
তাদের জীবন চক্রটি শুধু কাজ আর ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পুজোর শহরে দর্শক আনন্দে মেতে ওঠেন, কিন্তু শিল্পীর চোখে সেই আনন্দের কোন প্রতিফলন দেখা যায় না।
শিল্পী যেভাবে প্রতিমা তৈরিতে প্রাণ দেন, সেই প্রাণের পেছনে লুকিয়ে থাকে কষ্ট ও দুঃখের গল্প। 🎨
মহাজনের সুদের ফাঁদ একটি অদৃশ্য যন্ত্রণা
প্রতিমাশিল্পীদের জীবনে মহাজনের ঋণ একটি অবিরাম চক্রের মতো।
ঋণ নিয়ে প্রতিমা তৈরি, বিক্রির পর অংশ শোধ, তারপর আবার নতুন ঋণ—এই চক্র কখনও শেষ হয় না। প্রতিমাশিল্পীরা নানা বছর ধরে একই পরিস্থিতিতে জীবন কাটাচ্ছেন।
রাজীব পাল বলেন, “মহাজনের খাতায় আমরা বন্দি। আমাদের জীবন যেন শুধু ঋণ মেটানো আর প্রতিমা গড়ার চক্রে আটকে গেছে।”
এই অভিজ্ঞতা শুধু এক পরিবারের নয়, পুরো শহরের প্রতিমাশিল্পীদের জন্য অভিন্ন। প্রতিমাশিল্পীরা মা দুর্গার জন্য জীবন উৎসর্গ করেন, কিন্তু নিজেদের জীবন আর্থিক চাপের ফাঁদে সীমাবদ্ধ।
এই ঋণবোধ, সুদের বোঝা এবং নতুন ঋণের চক্র শিল্পীদের মানসিক চাপের উৎস।
পুজোর সময় দর্শকরা প্রতিমার সামনে আনন্দ উপভোগ করেন, মুগ্ধ হন, ছবি তুলেন, কিন্তু সেই আনন্দের আড়ালে শিল্পী দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন, কখনও ঋণমুক্তি পাচ্ছেন না।
প্রতিমাশিল্পীদের জীবনচক্রের এই বাস্তবতা দর্শকরা খুব কমই লক্ষ্য করেন। এভাবেই প্রতিমা তৈরির শিল্প এবং আর্থিক বাস্তবতা মিলেমিশে একটি কঠিন বাস্তবতা সৃষ্টি করে। 💔
সমাধানের প্রস্তাব ও ভবিষ্যৎ
এই সমস্যার সমাধান সহজ নয়, তবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে যা শিল্পীদের জীবনমান উন্নত করবে।
স্থানীয় সরকার ও সাংস্কৃতিক সংস্থা শিল্পীদের ঋণমুক্ত করতে বা কম সুদে ঋণ প্রদান করতে পারে।
এতে পরিবারগুলোর আর্থিক চাপ কমবে এবং তারা স্বাধীনভাবে প্রতিমা তৈরিতে মনোযোগ দিতে পারবেন।
মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে কম সুদে ঋণ দিলে উৎপাদন চক্র সহজ হবে।
এছাড়া শিল্পমেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে শহরের বাইরের দর্শকরা শিল্পীর কাজ সরাসরি দেখতে পারবেন, যা বিক্রির সুযোগ বৃদ্ধি করবে।
নবীন প্রজন্মকে আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজাইনের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে শিল্পের মান বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
শুভদীপদের মতো নতুন প্রজন্ম ঐতিহ্য ধরে রাখতে চায়, কিন্তু জীবনের বাস্তবতায় সীমাবদ্ধ।
আমাদের দায়িত্ব হলো তাঁদের সহায়তা করা, যাতে শিল্পীর প্রতিটি ছোঁয়ায় মায়ের রূপ শুধু শহরকেই নয়, শিল্পীর জীবনকেও আলোকিত করে।
এটি শুধু প্রতিমাশিল্পীর নয়, পুরো সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করা যায় এবং শিল্পীদের সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। 🌟
প্রতিমাশিল্পীর জীবন ও পুজোর আনন্দের পার্থক্য
শহরে পুজোর আনন্দ শুধু আলো, গান এবং ভিড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিমাশিল্পীর ঘরে সেই আনন্দ আসে না।
প্রতিমা তৈরির প্রতিটি মুহূর্তে শিল্পীরা রাত দিন শ্রম দেন, ঋণের বোঝা, উপকরণ ক্রয়, শ্রমিকদের মজুরি—সব মিলিয়ে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়।
দর্শক মুগ্ধ হয়, ছবি তুলে স্মৃতি সংরক্ষণ করে, কিন্তু শিল্পীর পরিশ্রম ও আর্থিক সংগ্রাম দেখেন না।
প্রতিমাশিল্পীদের জন্য এই কাজ শুধুই কাজ নয়; এটি জীবন, জীবিকা এবং পরিবারকে রক্ষা করার মাধ্যম।
তারা প্রতিমার প্রতিটি ছোঁয়ায় প্রাণ দেন, কিন্তু নিজেরা ঋণের ফাঁদে বন্দি থাকেন। এই বাস্তবতা প্রতিমার সৌন্দর্যের সঙ্গে যেন অদৃশ্য লুকিয়ে থাকে। 🎭
উপসংহার
পুরুলিয়ার প্রতিমাশিল্পীদের গল্প শুধুই দুর্গাপুজোর আনন্দের গল্প নয়। এটি একটি সংগ্রামের গল্প—ঋণ, সুদ, পরিবার, ঐতিহ্য এবং জীবনের কঠিন বাস্তবতার গল্প।
প্রতিমাশিল্পীরা মা দুর্গার প্রতিটি হাসি ও অশ্রুতে নিজের জীবনের গল্প বোনা রাখেন। শহরের মানুষ মুগ্ধ হয়, কিন্তু শিল্পীর চোখে কেবল অকুন্তল শ্রমের চিহ্ন থাকে।
মা দুর্গার রূপ আসে তাদের হাতে, কিন্তু সুদিন কখন আসবে—তার অপেক্ষা আজও চলছে।
আমাদের দায়িত্ব হলো এই শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করা, যেন প্রতিমা শুধু শহরকেই নয়, শিল্পীর জীবনকেও আলোকিত করে। 🙏