রোহিনে সাপ থেকে জিহুড় উৎসব মানভূমের প্রাচীন রীতি।
মানভূমে রোহিনে সাপের আগমন থেকে শুরু হয়ে জিহুড় উৎসবের আনন্দ ও ঐতিহ্য প্রচলিত।
শীতের আগমনের আগে কৃষিজীবি মানুষ নতুন ধান ঘরে তোলার আগে ঘর-বাড়ি ও খামার পরিস্কার করে, মা লক্ষ্মীর স্বাগত জানায় এবং প্রাচীন রীতি অনুযায়ী খামার বাঁধার আচার পালন করে।
উৎসব কেবল ফসলের নয়, বরং সামাজিক মিলনমেলা ও গ্রামের ঐক্যের প্রতীক।
শিশুরা খুশিতে নাচ-গান করে, যুবকরা সাংস্কৃতিক আয়োজন সম্পন্ন করে, আর পরিবারের সকলেই একত্রে ফসল ও সামাজিক বন্ধন উদযাপন করে।
জিহুড় উৎসব প্রমাণ করে কীভাবে প্রাকৃতিক চক্র, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও সামাজিক ঐক্য মিলিত হয়ে মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। 🌾✨
রোহিনে সাপের আগমন থেকে জিহুড় উৎসব: মানভূমের কৃষিজীবি পরম্পরা
শীতের আগমনের প্রাক্কালে, আশ্বিন সংক্রান্তির দিন পুরুলিয়া ও মানভূম অঞ্চলে পালিত হয় প্রাচীন ‘জিহুড়’ উৎসব। 🌾
এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন ফসল ঘরে তোলার পূর্বে প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের সঙ্গে মিল রেখে কৃষিজীবি জীবনকে উদযাপন করা।
প্রাচীন কালে, যখন মানুষ সম্পূর্ণভাবে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তখন এই দিনটি ছিল এক প্রকার সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মিলনমেলা।
গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতেন, জিহুড়ের দিন শেষ বৃষ্টিপাত হয় এবং ধান ও অন্যান্য ফসল ফলনের জন্য এটি সৌভাগ্যের দিন।
ডঃ ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাত বলেন, “‘জিও হোড়’ থেকে ‘জিহুড়’ শব্দটি এসেছে, যার অর্থ বেঁচে থাকা। এই দিনটি শেষ বৃষ্টিপাতের দিন হিসেবে গণ্য হয়।
রোহিনে বিষাক্ত সর্পগুলো গর্ত থেকে বের হয় এবং জিহুড়ের দিনে বৃষ্টির জল পান করে পুনরায় শীতের ঘুমে চলে যায়।”
এই উৎসবের মাধ্যমে কৃষকরা প্রকৃতির সঙ্গে সুষম সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং ফসলের সুরক্ষার জন্য আধ্যাত্মিক আচার পালন করেন।
জিহুড় উৎসব শুধুমাত্র কৃষিকাজ বা ফসলের জন্য নয়, এটি গ্রামের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনেরও প্রতীক।
প্রতিটি পরিবার এই দিনে নিজেদের ঘর ও খামার পরিষ্কার করে, তুলসী মঞ্চে আলপনা আঁকেন এবং মা লক্ষ্মীর স্বাগত জানান। 🌿🏡
মহিলারা ঘরে গোবর জল ছিটিয়ে ঘর পরিস্কার করেন এবং প্রদীপ জ্বালিয়ে নতুন ফসলের জন্য শুভেচ্ছা জানায়।
এই সব আচার কেবল সৌভাগ্যের প্রতীক নয়, বরং প্রাচীন রীতিনির্ভর শিক্ষাও বহন করে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে।
জিহুড় উৎসবের আধ্যাত্মিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্ব
জিহুড় উৎসবের আধ্যাত্মিক দিক অত্যন্ত গভীর। এই দিনে কৃষকরা বিশ্বাস করেন, তাদের খামার এবং ফসল অপদেবতা বা কুনজরের নজর থেকে রক্ষা পায়। 🌾
গৃহকর্তা মাটির হাড়ি, ভাঙা কারাহি, খড় ঢুলা, ঝাঁটা, কুলা ইত্যাদি রাখেন, এবং গৃহকর্ত্রী শালপাতায় তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালান।
এর মাধ্যমে নতুন ফসল ঘরে তোলার আগে সকল ধরনের খারাপ প্রভাব দূর হয়। বিশেষভাবে, ‘বাঁদনা’ আচারকালে গরুর শিংয়ে তেল মাখানো হয়। 🐄
কারণ গবাদি পশু কৃষিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের যত্ন নেওয়া এবং সম্মান প্রদর্শন করা পরিবারের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
ডঃ সনৎ কুমার মাহাত বলেন, “পরিবারে নতুন সদস্য আসার আগে যেমন গর্ভবতী মায়ের যত্ন নেওয়া হয়, তেমনি রোহিন পর্বে ধানগাছেরও যত্ন নেওয়া হয়। 🌱
নতুন ধান পরিপুষ্ট হয়, শুধু ফোটার অপেক্ষায় থাকে। কৃষকরা জমিতে ধানগাছকে ‘সাধভক্ষণ’ করান এবং খামার বাঁধেন যাতে অপদেবতার নজর এড়ানো যায়।”
এই আচারগুলি প্রমাণ করে যে, জিহুড় উৎসব কেবল আধ্যাত্মিক নয়, বরং কৃষিজীবির জন্য জীবনধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে।
কৃষিজীবির প্রাকৃতিক চক্র ও খামার বাঁধার আচার
কৃষকরা উৎসবের দিন খামার পরিষ্কার করে জমি সমতল করেন। কোদাল দিয়ে ঘাস ও আগাছা চেঁছে খামার প্রস্তুত করা হয়, যা ‘খামার বাঁধা’ নামে পরিচিত। 🏡
সন্ধ্যার পরে খামারে রাখা হয় মাটির হাড়ি, ভাঙা কারাহি, খড়ের ঢুলা, ঝাঁটা এবং ভাঙা কুলা।
এ আচারটি নিশ্চিত করে যে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় অপদেবতা বা কুনজরের কোনো প্রভাব পড়বে না।
গৃহকর্ত্রী শালপাতায় তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালান, যা নতুন ফসলকে শুভ্রতার সঙ্গে স্বাগত জানানোর প্রতীক।
এই সময় গবাদি পশুর সঠিক যত্ন দেওয়া হয়। বিশেষ করে গরু ও মহিষদের খামারে রাখা হয় এবং শিংয়ে তেল মাখানো হয়। 🐂
এ প্রথা নিশ্চিত করে যে কৃষিজীবি পরিবার এবং তাদের ফসলের জন্য এক ধরনের সৌভাগ্য আনয়ন করা হচ্ছে।
জিহুড় উৎসব প্রমাণ করে, প্রাকৃতিক চক্র, কৃষিজীবির জীবনধারা এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাস কিভাবে একত্রে মিলিত হয়ে সমাজ ও পরিবারকে সমৃদ্ধ করে।
নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দ ও সামাজিক ঐক্য
জিহুড় উৎসব কেবল কৃষিজীবি পরিবারের নয়, পুরো গ্রামের মিলনমেলার প্রতীক। 🎉 গ্রামের শিশু ও যুবকরা নাচ-গান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
প্রতিটি পরিবার নতুন ধান ঘরে তোলার আগে মা লক্ষ্মীর স্বাগত জানায়। এই আচারগুলি ফসলের সঙ্গে পরিবার ও গ্রামের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে।
গ্রামের মানুষ একে অপরের সঙ্গে ধান বিনিময়, খাবার ভাগাভাগি এবং খামারে সহযোগিতা করে। 🌿
এই সামাজিক মিলনমেলা শুধুমাত্র আনন্দ নয়, বরং এক ধরনের সামাজিক শিক্ষা ও ঐক্যের প্রতীক।
কৃষকরা দেখায় যে কেবল ফসল নয়, মানুষের সহমর্মিতা ও ঐক্যও সমাজকে সমৃদ্ধ করে।
জিহুড় উৎসব প্রমাণ করে, সামাজিক বন্ধন ও ঐতিহ্য কিভাবে প্রাকৃতিক চক্রের সঙ্গে মিলিত হয়।
উপসংহার: প্রাচীন রীতি ও সমৃদ্ধির বার্তা
রোহিনে সাপের আগমন থেকে জিহুড় উৎসব পর্যন্ত, মানভূমের মানুষ তাদের কৃষিজীবি জীবন, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস এবং সামাজিক বন্ধন উদযাপন করে। 🌾✨
নতুন ধানের স্বাগত, পরিবার ও গ্রামের সমৃদ্ধি, এবং সামাজিক ঐক্য—সবই এই উৎসবের মূল বার্তা।
জিহুড় উৎসব প্রমাণ করে, কিভাবে মানুষের জীবন প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমৃদ্ধি অর্জন করে।
পুরুলিয়া ও মানভূমের এই প্রথা আজও জীবন্ত, যা আমাদেরকে শিখায় যে আচার, বিশ্বাস এবং প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় কিভাবে সমৃদ্ধ জীবন দেয়।
