ঝালদার সিলফোঁড় পাহাড়ের কালী মন্দিরের অজানা ইতিহাস।
ঝালদার সিলফোঁড় পাহাড়ের কালী মন্দির একসময় ছিল বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়স্থল, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা গোপনে পরিকল্পনা করতেন আন্দোলনের।
সময়ের সঙ্গে সেই পাহাড়ই পরিণত হয় ভক্তি ও ঐতিহ্যের প্রতীকে। আজ এখানে প্রতিদিন ভক্তদের ভিড়, ঘণ্টাধ্বনি আর ধূপের গন্ধে মুখরিত থাকে চারপাশ।
মন্দিরের ইতিহাস, পাহাড়ের সৌন্দর্য, আর মানুষের অনুভূতির গল্প মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে ঝালদার গর্ব ও ধর্মীয় ঐক্যের প্রতীক। জানুন এই অনন্য মন্দিরের সম্পূর্ণ ইতিহাস, প্রতিষ্ঠার কাহিনি ও ভক্তির মাহাত্ম্য। 🌺🙏
🌺 একদা বিপ্লবীদের গোপন ডেরা আজ ঝালদার ভক্তির কেন্দ্র সিলফোঁড় পাহাড়ের মা কালী মন্দিরের অজানা ইতিহাস
ঝালদা শহরের অন্তরে এক পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে, যার বুক জুড়ে ইতিহাস, ভক্তি আর সংস্কৃতির অম্লান ছাপ। সেই পাহাড়ই আজ পরিচিত সবার কাছে সিলফোঁড় পাহাড় নামে।
এখানে অবস্থিত মা কালী মন্দির শুধুমাত্র এক ধর্মীয় স্থান নয়, বরং এটি ঝালদার গর্ব, পরিচয় আর ঐতিহ্যের প্রতীক।
একসময় এই পাহাড়ে গোপনে আশ্রয় নিতেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীরা। পাহাড়ের ঘন বন, প্রাকৃতিক দুর্গমতা এবং নির্জন পরিবেশ ছিল তাদের রক্ষা-কবচ।
সময়ের আবর্তে সেই গোপন আশ্রয়ই একদিন পরিণত হয় পবিত্র ভক্তিক্ষেত্রে। আজ এই পাহাড়ে ভোরবেলা থেকে শুরু হয় ঘণ্টাধ্বনি, ধূপের গন্ধ আর ভক্তদের পদচারণা।
দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে এখানে প্রার্থনা করতে, আশীর্বাদ নিতে। মা কালী যেন আজও পাহাড়ের বুক জুড়ে জাগ্রত, আশ্রয় দেন সকলের দুঃখে-সুখে।
ইতিহাসের পাথরে খোদাই হয়ে আছে এই মন্দিরের গল্প, যেখানে মিলেমিশে আছে বিপ্লবের গৌরব ও ভক্তির প্রশান্তি। 🌄
🕉️ ইতিহাসের পাতায় সিলফোঁড় পাহাড় ও বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়
যে ঝালদা আজ শান্ত ও উন্নত শহর, সেই ঝালদা একসময় ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
স্থানীয়দের মুখে মুখে আজও প্রচলিত — সিলফোঁড় পাহাড়ই ছিল বিপ্লবীদের গোপন ডেরা। স্বাধীনতার আগুন যখন ধীরে ধীরে সারাদেশে জ্বলতে শুরু করে, তখন ঝালদার এই পাহাড়ের গুহা আর বনাঞ্চল হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের গোপন বৈঠকের জায়গা।
তারা এখানে বসে দেশমাতৃকার মুক্তির পরিকল্পনা করতেন। দিনভর লুকিয়ে থেকে রাতের অন্ধকারে চুপিসারে চলত তাদের আন্দোলনের প্রস্তুতি। পাহাড়ের বুকে প্রতিধ্বনিত হতো দেশের প্রতি শপথের সুর।
বলা হয়ে থাকে, এই পাহাড়েই বহুবার গোপনে বৈঠক করেছেন ঝালদার এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তরুণ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।
কেউ কেউ স্থানীয়দের সাহায্যে পাহাড়ের আশ্রয়ে রাত কাটাতেন, আবার কেউ পাহাড়ের গুহায় খাবার রেখে যেতেন লুকিয়ে।
আজও প্রবীণ বাসিন্দারা বলেন, পাহাড়ের নীচের কিছু গর্ত ও পাথরের ফাঁক আজও সেই সময়ের স্মৃতি বহন করে।
স্বাধীনতার সূর্য ওঠার পরও বহুদিন পর্যন্ত এই পাহাড় ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে ছিল। আর এই ঐতিহাসিক স্মৃতিকে ভক্তির রূপে বাঁচিয়ে রেখেছে আজকের মা কালী মন্দির। 🌿🔥
🌼 প্রেমচাঁদ মোদকের উদ্যোগে মন্দির প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণামূলক গল্প
স্বাধীনতার পর ঝালদার মানুষ চেয়েছিলেন এমন এক পবিত্র স্থান, যেখানে তারা ইতিহাসের স্মৃতি ও ভক্তির মেলবন্ধন ঘটাতে পারবেন।
সেই ভাবনা থেকেই সমাজসেবক প্রেমচাঁদ মোদক উদ্যোগ নেন এই পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটি কালী মন্দির নির্মাণের। তাঁর দৃঢ় মনোবল ও বিশ্বাসই আজকের সিলফোঁড় পাহাড়ের মা কালী মন্দিরের ভিত্তি।
তিনি বিশ্বাস করতেন, যেখানে একদিন দেশের জন্য ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের ইতিহাস রচিত হয়েছে, সেই স্থানেই দেবীর শক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
তাঁর উদ্যোগে স্থানীয় মানুষজন হাত লাগান কাজের সঙ্গে। ছোট ছোট দান, শ্রম, ও মানুষের ভালোবাসায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এই মন্দির।
প্রায় ১৩০টি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা সত্যিই অপরূপ। নীচের শহর দেখা যায় স্বপ্নের মতো, আর ওপরে মা কালী দাঁড়িয়ে যেন পাহারা দিচ্ছেন পুরো ঝালদাকে।
মন্দিরের প্রতিটি ইট যেন গল্প বলে — একদা বিপ্লবীদের পাহাড়ে আজ দেবীর নিবাস। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সাংসদ দেবেন্দ্রনাথ মাহাতোর সহায়তায় মন্দিরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয়।
তারপর বহু বছর পর ২০১৭ সালে ঝালদা পৌরসভার উদ্যোগে মন্দিরটি নতুন সাজে সেজে ওঠে।
রঙিন প্রাচীর, উন্নত সিঁড়ি, আলোকসজ্জা — সব মিলিয়ে এক মহিমান্বিত চেহারা পায় মা কালী মন্দির। 🛕✨
🙏 ভক্তি, অনুভূতি ও মানুষের ভালোবাসার জাদু
আজকের দিনে সিলফোঁড় পাহাড় শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং এটি ঝালদার মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক পবিত্র অনুভূতি।
প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু হয় ঘণ্টাধ্বনি, ধূপের গন্ধ আর ভক্তদের পদধ্বনি। মা কালী মন্দিরের পূজারী দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন,
“প্রতিদিনই মা-র দর্শনে শত শত ভক্ত আসেন। মা-র পুজোর সময় প্রস্তুতি থাকে তুঙ্গে। সবাই বিশ্বাস করেন মা তাদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন।”
মন্দিরের পরিবেশে রয়েছে এক অদ্ভুত শান্তি। এখানে এসে যেন মানুষ ভুলে যায় জীবনের ক্লান্তি। বাতাসে মিশে থাকে ফুল, প্রদীপ ও প্রার্থনার সুবাস।
শিশু থেকে বৃদ্ধ — সকলেই এখানে সমানভাবে আকৃষ্ট। উৎসবের সময় পাহাড়ের চারপাশে বসে যায় মেলা, ভক্তদের ঢল নামে।
রাতে যখন প্রদীপ জ্বলে ওঠে, পুরো পাহাড় যেন আলোয় ভেসে যায়। এমন দৃশ্য চোখে পড়লে মনে হয়, দেবী মা নিজেই উপস্থিত আছেন পাহাড়ের প্রতিটি কোণে। 🌺
🌄 প্রকৃতি, পাহাড় ও ভক্তির এক সুরেলা মিলন
সিলফোঁড় পাহাড়ের সৌন্দর্য এককথায় অপূর্ব। এখান থেকে পুরো ঝালদা শহর দেখা যায় পরিষ্কারভাবে
পুজোর সময় যখন শহরের প্রতিটি বাড়ি, গলি, আর মন্দির আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে, তখন পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখলে মনে হয় — ভক্তি আর প্রকৃতি যেন মিশে গেছে এক আলোকরশ্মিতে।
স্থানীয় বাসিন্দা বলরাম মণ্ডল বলেন,
“পাহাড়ের ওপর থেকে পুজোর রাতে ঝালদা শহরের আলোয় ভরা দৃশ্য দেখলে মনে হয়, মা কালী যেন নিজের আলোয় ঝলমল করছেন।”
পাহাড়ের গায়ে বাতাসে ভেসে আসে ধূপের গন্ধ, পাখিদের কিচিরমিচির, আর মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি। এই পরিবেশ একদিকে যেমন ধর্মীয়, তেমনই প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।
সকালবেলা সূর্যের প্রথম আলো যখন মা কালী মূর্তির ওপর পড়ে, তখন মনে হয় প্রকৃতিও যেন প্রণাম করছে দেবীকে। 🌞🌿
🧘♀️ পুজোর প্রস্তুতি, নিরাপত্তা ও মানুষের ঐক্যবদ্ধতা
প্রতি বছর কালীপুজোর সময় ঝালদার সিলফোঁড় পাহাড়ে চলে উৎসবের আমেজ। শহরের মানুষ ও আশেপাশের গ্রামবাসীরা মিলে তৈরি করেন পুজো কমিটি।
প্রস্তুতি শুরু হয় মাসখানেক আগে থেকেই — মন্দির পরিষ্কার করা, আলো বসানো, সাজসজ্জা করা, সব কিছুতেই সবার আন্তরিক অংশগ্রহণ।
এই সময় পৌরসভা ও স্থানীয় থানা নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। পাহাড়ের সিঁড়ি থেকে নিচের রাস্তাগুলো পর্যন্ত ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা সারাদিন দায়িত্বে থাকেন।
পুজো কমিটির সদস্য অনুপ কুমার চোপড়া বলেন,
“সব প্রস্তুতি এখন প্রায় শেষ। আশা করছি, এ বছরও ভক্তদের উপচে পড়া ভিড় হবে। সবাই যেন শান্তিপূর্ণভাবে পুজো উপভোগ করতে পারেন, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।”
এই ঐক্য ও ভক্তির মিলনই ঝালদার মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ধর্ম শুধু আচার নয়, এখানে তা হয়ে ওঠে সমাজের বন্ধনের প্রতীক। 🎇
🏛️ উন্নয়ন, পর্যটন ও পৌরসভার নতুন উদ্যোগ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঝালদা পৌরসভা মন্দিরের আশেপাশের এলাকাকে উন্নত ও সুন্দর রাখার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে।
সিঁড়িগুলোর মেরামত, নতুন লাইট পোস্ট, বসার জায়গা তৈরি, পানীয় জলের ব্যবস্থা — সবই পর্যটকদের সুবিধার জন্য।
পৌরসভার চেয়ারম্যান বলেন,
“সিলফোঁড় পাহাড়ের মা কালী মন্দির ঝালদার গর্ব। আমরা চাই এটি শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, বরং একটি পর্যটন আকর্ষণ হিসেবেও গড়ে উঠুক।”
আজকাল অনেক ভ্রমণপ্রেমী, ফটোগ্রাফার ও ইতিহাসপ্রেমী এখানে ভিড় জমান। বিশেষত সন্ধ্যার সময় পাহাড়ের আলোয় মন্দিরের দৃশ্য দেখে অনেকে মুগ্ধ হন।
পুরুলিয়া ভ্রমণে যারা আসেন, তাদের তালিকায় এখন এই মন্দির অন্যতম দর্শনীয় স্থান। 🌿✨
🌟 শেষকথা: ইতিহাসের ছোঁয়া ভক্তির সুবাসে ভরা ঝালদার সিলফোঁড় পাহাড়ের কালী মন্দির
ঝালদার মানুষের কাছে এই মন্দির কেবল এক দেবীর আসন নয় — এটি তাদের হৃদয়ের স্পন্দন, জীবনের আশ্রয়।
এখানে এসে মানুষ খুঁজে পান শান্তি, ভক্তি আর অতীতের গৌরব। যে পাহাড় একসময় বিপ্লবীদের গোপন ডেরা ছিল, আজ তা হয়ে উঠেছে আধ্যাত্মিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু।
প্রতিদিন ভোরে যখন সূর্যের আলো পাহাড়ের চূড়ায় পড়ে, তখন মনে হয় যেন ইতিহাস আবার নতুন করে জেগে উঠেছে।
ভক্তরা বলেন, “মা কালী আমাদের রক্ষা করেন, আমাদের শহরকে আশীর্বাদে ভরিয়ে রাখেন।”
সত্যিই, সিলফোঁড় পাহাড়ের মা কালী মন্দির ঝালদার মানুষের জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থাকবে। ❤️🕉️