জিতিয়া পরব ২০২৫: নারীশক্তি, কৃষি, প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের মিলনমেলা।
জিতিয়া পরব শুধু একটি উৎসব নয়, এটি নারীশক্তি, কৃষি ও প্রকৃতির অনন্য মিলনমেলা।
বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত এই আদি পরব আজও আদিবাসী সমাজের প্রাণের স্পন্দন বহন করে।
নারীরা সন্তান ও স্বামীর মঙ্গল কামনায় কঠোর উপবাস পালন করেন এবং আঁখ, শশা, বটবৃক্ষের মতো প্রতীকী উপকরণে প্রকৃতি মাতাকে আরাধনা করেন।
কৃষিনির্ভর এই উৎসবে নতুন বীজ বপনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ফসলের সম্ভাবনা যাচাই করা হয়, যা বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে।
নাচ, গান, মাদলের তালে তালে জিতিয়ার আনন্দে মাতোয়ারা হয় গ্রামীণ জনজীবন।
আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, নারী শক্তির উদযাপন ও প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা—সব মিলিয়ে জিতিয়া পরব হয়ে ওঠে বাংলার ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ।
🌾 জিতিয়া পরব ২০২৫ নারীশক্তি কৃষি ও প্রকৃতির মিলনমেলা
✨ জিতিয়া পরবের পরিচয় ও মূল তাৎপর্য
ছোটনাগপুর অঞ্চলের অন্তরে লুকিয়ে আছে এমন অনেক উৎসব, যা প্রাচীনকাল থেকে গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। এর মধ্যেই একটি অনন্য উৎসব হলো জিতিয়া বা জিতুয়া পরব।
এই উৎসবকে অনেকেই শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় রীতি বা আদিবাসী সমাজের আচার হিসেবে দেখেন।
কিন্তু বাস্তবে এর মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান, কৃষির ঐতিহ্য এবং নারীর আত্মত্যাগের অসাধারণ কাহিনি।
জিতিয়া পরব মূলতঃ কৃষিভিত্তিক উৎসব, যার লক্ষ্য প্রকৃতি মাকে তুষ্ট করা, কারণ কৃষক সমাজ বিশ্বাস করে প্রকৃতিই তাদের আসল দেবতা।
বৃষ্টি, ফসল, গবাদিপশু এবং জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিস প্রকৃতি থেকেই আসে, তাই তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এই উৎসবের আয়োজন।
এই উৎসবের এক বিশেষ দিক হলো এর সরলতা। এখানে নেই পুরোহিত, নেই শাস্ত্রবদ্ধ আচার-বিধির বাঁধন।
স্থানভেদে আচার-অনুষ্ঠানে কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল সুর এক—প্রকৃতিকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানানো।
মা ও সন্তান, স্বামী ও পরিবারের মঙ্গল কামনায় নারীরা কঠিন উপবাসে অংশ নেন। আখ, বটগাছ ও শসা প্রতীকী উপকরণ হিসেবে পূজায় ব্যবহৃত হয়।
বটগাছ দীর্ঘায়ু ও সহনশীলতার প্রতীক, আখ মিষ্টতা ও পুষ্টির প্রতীক, আর শসা হলো সন্তানের প্রতীক। এই প্রতীকী উপকরণগুলিই প্রমাণ করে মানুষ কতটা গভীরভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে।
ফলে জিতিয়া পরব শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও এক অমূল্য ঐতিহ্য।

👩👧 নারীশক্তি মাতৃত্ব ও পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক
জিতিয়া পরবকে অনেকেই নারীর উৎসব বলেন, কারণ এর প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হলো নারী, বিশেষ করে মা।
এই দিনে মায়েরা তাদের সন্তান ও স্বামীর দীর্ঘায়ু, স্বাস্থ্য ও সুখের জন্য কঠোর উপবাস করেন। এটি নিছকই আচার নয়, বরং মাতৃত্বের এক মহিমান্বিত প্রকাশ।
করম পরব যেমন ভাইয়ের সুরক্ষার প্রতীক, তেমনি জিতিয়া পরব হলো মা ও সন্তানের গভীর সম্পর্কের প্রতীক। নারী সমাজের আত্মত্যাগ, ধৈর্য ও সহনশীলতা এখানে পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়।
এই উৎসবের সময় মায়েরা শুধু নিজেদের পরিবার নয়, তাঁদের মাতৃকুল, পিতৃকুল ও শ্বশুরবাড়ির পূর্বপুরুষদেরও স্মরণ করেন।
পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ কামনা করে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে তাঁদের সন্তান ও পরিবার সুস্থ, সবল ও সমৃদ্ধ থাকবে।
উপবাসের মাধ্যমে নারীরা যে মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মশক্তি অর্জন করেন, তা পরিবার ও সমাজে এক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
জিতিয়া পরব নারীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানী ও গবেষক সত্ত্বাকেও সামনে আনে। প্রাচীনকালে নারীরাই পরীক্ষা করে নির্ধারণ করতেন কোন শস্য ভোজ্য আর কোনটি বিষাক্ত।
তাঁরা নিজেদের জীবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে সমাজের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করেছেন।
তাই এই উৎসব নারীর জ্ঞান, শক্তি, ত্যাগ ও মাতৃত্বের অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। বর্তমান সমাজে যখন নারীশক্তির মূল্যায়ন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তখন জিতিয়া পরব তার একটি অনন্য প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

🌱 কৃষি বিজ্ঞান গবেষণা ও ঐতিহ্যের সংযোগ
জিতিয়া উৎসবের পেছনে শুধু আধ্যাত্মিকতা নয়, আছে গভীর কৃষিবিজ্ঞান। এই উৎসবে যে শস্য, পাতা বা গাছ ব্যবহার করা হয়, তা নিছকই প্রতীকী উপকরণ নয়, বরং কৃষি গবেষণার অংশ।
নারীরা এই সময় বিভিন্ন দানাশস্য বপন করে দেখতেন কোনটি ফসল ফলানোর উপযোগী, কোনটি বিষাক্ত।
এটি একধরনের প্রাচীন কৃষি পরীক্ষা, যার মাধ্যমে কৃষি সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। আজকের দিনে যাকে আমরা ল্যাবরেটরি বলি, সেই কাজটাই করতেন গ্রামীণ নারীরা মাঠে ও ঘরে বসেই।
প্রসাদ হিসেবে ব্যবহৃত প্রতিটি শস্য বা গাছের আলাদা পুষ্টিগুণ আছে। যেমন দানাশস্য মানুষ খায়, পাতা দেওয়া হয় গবাদি পশুকে।
এতে গবাদি পশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে, ফলে কৃষিকাজেও তারা শক্তি জোগায়। এইভাবে মানুষের জীবন ও পশুপালন পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে।
কৃষিজীবী সমাজে পশুর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, তাই জিতিয়া পরবে তাঁদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এই উৎসব প্রমাণ করে কৃষি সভ্যতার বিকাশে নারীর অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আজকের বিজ্ঞানের আলোয় আমরা যেভাবে গবেষণা করি, প্রাচীন নারীরাই সেই কাজ করতেন সাহস ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে।
তাই জিতিয়া উৎসবকে কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষি ও বিজ্ঞানের এক মহামূল্যবান সম্পদ বলা যায়।
🥗 অঙ্কুরিত দানাশস্য ও সুস্বাস্থ্যের প্রাচীন রহস্য
জিতিয়া পরবে অঙ্কুরিত শস্যের ব্যবহার এক বৈজ্ঞানিক কৌশল। প্রাচীন মানুষ রান্না না করে কাঁচা শস্য, ফলমূল ও শাকপাতা খেত, যার ফলে তাদের দেহ ছিল সবল ও রোগমুক্ত।
আগুনের আবিষ্কারের পর রান্না খাবার জনপ্রিয় হলেও, তাতে অনেক ভিটামিন, এনজাইম ও মিনারেল নষ্ট হয়ে যায়।
আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানও বলে— রান্না খাবারের পাশাপাশি কাঁচা শস্য ও অঙ্কুরিত খাদ্য গ্রহণ শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
অঙ্কুরিত শস্যে প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল থাকে, যা হজমে সাহায্য করে, শরীরকে শক্তিশালী করে ও আয়ু বাড়ায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যে প্রাণী সাবালক হতে যত বছর নেয়, তার গড়ে ছয় গুণ বেশি আয়ু হয়।
সেই হিসাবে মানুষের আয়ুষ্কাল হওয়া উচিত ১২০ বছর, কিন্তু আমরা ৬০–৭০ বছরের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। এর অন্যতম কারণ আমাদের খাদ্যাভ্যাস।
তাই প্রাচীন প্রথার মতো যদি আমরা কাঁচা ফলমূল, সবজি ও অঙ্কুরিত শস্য খাবারে যুক্ত করি, তবে সুস্থ থাকা সহজ হবে।
জিতিয়া পরব এভাবেই আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষার এক প্রাচীন শিক্ষা দেয়।
উপবাস শেষে এই অঙ্কুরিত শস্য খাওয়ার মধ্যে দিয়ে শরীর আবার শক্তি ফিরে পায়। তাই এ উৎসব শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সুস্থ জীবনের পথও দেখায়।
🍬 আখ বা আঁখের প্রতীকী শক্তি ও উপকারিতা
আখ জিতিয়া পরবের আরেকটি প্রধান উপকরণ। ছোটনাগপুর অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই আখ চাষ হয় এবং এখান থেকেই প্রথম গুড় তৈরি হয়।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এই গুড় নৌপথে রপ্তানি হতে হতে গোটা ভারতবর্ষ ও বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
আরবরা এখান থেকে চিনি নিয়ে যায়, পরে ইউরোপে পৌঁছে তা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়। তাই আখ শুধু একটি ফসল নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাণিজ্যের অংশও।
আখের গুরুত্ব কেবল ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ নয়। এর স্বাস্থ্যগুণ অসাধারণ। উপবাস শেষে আখ তাৎক্ষণিক শক্তি জোগায়, কারণ এতে প্রাকৃতিক গ্লুকোজ প্রচুর পরিমাণে থাকে।
এতে আছে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস, যা দাঁত ও হাড়কে মজবুত করে। গর্ভধারণে সাহায্য করে ফলিক অ্যাসিড, লিভার ও হজমের সমস্যাও দূর করে আখ।
তাই জিতিয়া উপবাস শেষে আখ ভাগাভাগি করে খাওয়া শুধু ঐতিহ্য নয়, স্বাস্থ্য রক্ষারও উপায়।
প্রাচীন সমাজে আখের প্রতীকী অর্থও গভীর। এটি মিষ্টতা, পুষ্টি ও দীর্ঘায়ুর প্রতীক।
যেমন সন্তান যেন আখের মতো সবল হয়, জীবন যেন আখের মতোই মধুর হয়। এই বিশ্বাসই আখকে জিতিয়া পরবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান করে তুলেছে।
🧘 উপবাস মানসিক শক্তি ও শরীরের শুদ্ধি
জিতিয়া পরবের মূল আচার হলো উপবাস। অনেকেই মনে করেন উপবাস কেবল ধর্মীয় প্রথা, কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্যও কম নয়।
উপবাসে শরীরের হজমতন্ত্র বিশ্রাম পায়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নতুন শক্তি সঞ্চয় করে। পাকস্থলী, লিভার, কিডনি, অন্ত্র সবই সুস্থ হয়ে ওঠে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয়, উপবাস করলে রক্ত পরিশুদ্ধ হয়, ক্রোধ ও কামনা নিয়ন্ত্রণে আসে, মন শান্ত হয়।
ইতিহাসে দেখা যায়, প্রাচীন দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো ও পিথাগোরাসও উপবাসের মাধ্যমে মানসিক শক্তি অর্জন করতেন।
তাঁরা বিশ্বাস করতেন, উপবাস করলে মনের স্বচ্ছতা বাড়ে, ফলে গভীর দর্শনচিন্তা সম্ভব হয়। তাই উপবাসকে কেবল ধর্মীয় দিক থেকে নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক শুদ্ধির এক প্রাচীন বিজ্ঞান বলা যায়।
জিতিয়া উপবাস তাই নারীর আত্মশক্তি ও সহনশীলতার প্রতীক। দিনের পর দিন কঠিন উপবাসের পরও তাঁরা পরিবার ও সমাজের মঙ্গল কামনায় অংশ নেন।
এটি তাদের মানসিক দৃঢ়তা, আধ্যাত্মিক শক্তি ও অসীম ভালোবাসার এক অনন্য প্রকাশ।
🎶 নাচ গান ও সাংস্কৃতিক আবহ
জিতিয়া পরব শুধু উপবাসের আচারেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সাংস্কৃতিক দিকও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই দিনে গ্রামের মানুষ নতুন পোশাক পরে আনন্দে মেতে ওঠেন।
কিশোরীরা খোঁপায় ফুল গুঁজে, মাদলের তালে তালে নাচে, গান গায়। চারপাশে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।
বিশেষ করে জিতিয়া গান এই উৎসবের এক অমূল্য সম্পদ। এসব গানে ফুটে ওঠে নারীর সংগ্রাম, দুঃখ, ভালোবাসা এবং জীবনের বেদনামধুর কাহিনি।
নাচ-গানের মধ্য দিয়ে তারা শুধু আনন্দ প্রকাশ করেন না, বরং নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবিও তুলে ধরেন।
জিতিয়া পরব এভাবেই একদিকে প্রকৃতির উপাসনা, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক আনন্দের সমন্বয় ঘটায়। এটি মানুষের মধ্যে মিলন, ভালোবাসা ও ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
তাই এই উৎসব শুধু আচার নয়, বরং জীবনের আনন্দ ও সৌন্দর্যেরও প্রতীক।
🌟 উপসংহার
জিতিয়া পরব হলো প্রকৃতি, নারীশক্তি, কৃষি ও বিজ্ঞানের এক অনন্য সমন্বয়। এটি শুধু উপবাস বা পূজার উৎসব নয়, বরং জীবনের পাঠ, বিজ্ঞান ও ঐতিহ্যের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
মায়ের ভালোবাসা, কৃষির জ্ঞান, স্বাস্থ্যরক্ষা এবং সাংস্কৃতিক আনন্দ—সবকিছুর এক মিলনমেলা এই জিতিয়া উৎসব।
আজকের প্রজন্ম যদি এই উৎসবের তাৎপর্য বোঝে, তবে তারা শিখবে—ঐতিহ্য কেবল ধর্মীয় আচারে সীমাবদ্ধ নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের পাঠ ও জীবনের গভীর সত্য।