পুরুলিয়ায় যুব সংগঠনের ৭ দফা দাবিতে তীব্র বিক্ষোভ।
পুরুলিয়ায় এআইডিও যুব সংগঠনের উদ্যোগে সাত দফা দাবিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হল বৃহৎ বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন কর্মসূচি।
কর্মসংস্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ পূরণ, স্থানীয় যুবকদের অগ্রাধিকার, হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়ন, যুবশ্রী প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তদের নিয়োগ, মদ-মাদক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধকরণ এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা—এই দাবিগুলি নিয়ে রাস্তায় নামলেন শতাধিক যুবক।
পুলিশের ব্যারিকেড সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ অবস্থান চালিয়ে গেলেন তাঁরা। জেলা প্রশাসনের কাছে ডেপুটেশন জমা দিয়ে দাবি আদায়ের স্পষ্ট বার্তা দিলেন। যুব সংগঠনের হুঁশিয়ারি, দাবি পূরণ না হলে ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর আন্দোলন হবে।
📰 পুরুলিয়ায় যুব সংগঠনের ৭ দফা দাবিতে তীব্র বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন
পুরুলিয়া জেলা সদর আজ এক বিশেষ দিনের সাক্ষী থাকল। সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে জমায়েত হতে শুরু করেন শত শত যুবক।
তাঁরা কেউ এসেছেন গ্রাম থেকে, কেউ আবার ব্লকের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। মূল লক্ষ্য একটাই—নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দাবিতে সরব হওয়া।
অল ইন্ডিয়া ডেমোক্র্যাটিক ইয়ুথ অর্গানাইজেশন বা এআইডিও-র (AIDYO) আহ্বানে আয়োজিত হয়েছিল এই বিশাল বিক্ষোভ-ডেপুটেশন কর্মসূচি।
আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাত দফা দাবি, যা শুধু যুবসমাজের জন্য নয়, জেলার সাধারণ মানুষের জীবন ও সমাজের সামগ্রিক উন্নতির সঙ্গে জড়িত।
মিছিল শুরু হয়েছিল পুরুলিয়ার জুবিলি ময়দান থেকে এবং ধাপে ধাপে শহরের প্রধান রাস্তা ধরে এগোতে থাকে জেলা শাসকের দপ্তরের উদ্দেশ্যে।
শহরজুড়ে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ—“কাজ চাই, অধিকার চাই”, “শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে চাই”, “মাদক মুক্ত সমাজ চাই”—এইসব স্লোগান যেন প্রতিটি যুবকের বুকের গভীর যন্ত্রণা ও প্রত্যাশার প্রতিচ্ছবি।
পুলিশের বাধা, প্রশাসনিক ব্যারিকেড, তবুও থেমে থাকেনি যুবসমাজের দৃঢ় কণ্ঠস্বর। এদিন পুরুলিয়ার আকাশে যেন ভেসে উঠল ভবিষ্যতের লড়াইয়ের ইঙ্গিত।
✊ সাত দফা মূল দাবির তাৎপর্য
এই আন্দোলনের প্রাণ ছিল সাতটি সুস্পষ্ট দাবি। প্রতিটি দাবিই গভীর বাস্তবতা থেকে উঠে এসেছে এবং প্রতিটি দাবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে জেলার হাজারো পরিবারের স্বপ্ন ও সংগ্রাম।
প্রথম দাবি হলো সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পুরুলিয়ার অসংখ্য যুবক কাজের সন্ধানে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেন, যেখানে প্রায়ই তাঁরা অনিরাপদ অবস্থায় শ্রম দেন এবং দুর্ঘটনা বা শোষণের শিকার হন।
দ্বিতীয় দাবি কর্মসংস্থান—যেখানে জেলার প্রতিটি বেকারের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
তৃতীয়ত, জেলার কারখানাগুলিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় যুবকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে, যাতে বাইরের লোক নয় বরং জেলার ছেলেমেয়েরাই উপকৃত হয়।
চতুর্থ দাবি স্কুলসহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগ। বর্তমানে বহু স্কুল একজন শিক্ষক দিয়ে চলছে, ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার মান নিম্নমুখী।
পঞ্চম দাবি সামাজিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—মদ ও মাদকদ্রব্য সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা।
ষষ্ঠ দাবি যুবশ্রী প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত যুবকদের অবিলম্বে নিয়োগ করা, কারণ বহু যুবক এই প্রকল্পের অধীনে নথিভুক্ত হয়েও কাজ পাচ্ছেন না।
সপ্তম ও শেষ দাবি স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে—পুরুলিয়ার প্রতিটি হাসপাতালে আধুনিক পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং শ্রমনিবিড় শিল্প স্থাপন।
এই দাবিগুলির প্রতিটিই সমাজের প্রয়োজন ও সময়োপযোগী, যা বাস্তবায়িত হলে জেলার চেহারায় বড় পরিবর্তন আসবে।
🚶♂️ মিছিলের আবহ ও পুলিশি বাধা
পুরুলিয়া শহরের জুবিলি ময়দান থেকে শুরু হওয়া মিছিল ছিল এক কথায় ঐতিহাসিক। বিভিন্ন বয়সের যুবক-যুবতীরা হাতে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড এবং লাল পতাকা নিয়ে জমায়েত হয়েছিলেন।
তাঁদের স্লোগান ছিল জোরালো ও স্পষ্ট—“কাজ চাই, অধিকার চাই”, “শিক্ষা-স্বাস্থ্য সবার অধিকার”—এই ধ্বনি শহরের প্রতিটি মোড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
মিছিল শহরের প্রধান রাস্তাগুলি অতিক্রম করে জেলা শাসকের দপ্তরের সামনে পৌঁছায়। কিন্তু সেখানেই প্রশাসন ব্যারিকেড দিয়ে মিছিল আটকায়।
পুলিশি বাধা সত্ত্বেও মিছিল থেমে যায়নি; যুবকরা সেখানেই বসে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভে সামিল হন।
তাঁদের চোখেমুখে ছিল দৃঢ় সংকল্প এবং বুকভরা আশা যে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবেই।
সাধারণ মানুষও এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন এবং অনেকেই সমর্থন জানান। পুরুলিয়া শহরের একাংশ যেন সেদিন রূপ নেয় এক আন্দোলনের মঞ্চে।
🎤 নেতৃত্বের বক্তব্য ও আন্দোলনের দিশা
এই কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন এআইডিওর পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক স্বদেশ প্রিয় মাহাত, রাজ্য কমিটির সদস্য শঙ্খ কর্মকার এবং জেলা সভাপতি সন্তোষ গড়াই।
স্বদেশ প্রিয় মাহাত স্পষ্ট ভাষায় জানান যে বর্তমানে পুরুলিয়ার ৬০ হাজারেরও বেশি যুবক এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম নথিভুক্ত করেছেন, কিন্তু তাঁদের কাজ নেই।
জেলার প্রায় ৩০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষক দিয়ে চলছে, যা শিক্ষার মানকে বিপর্যস্ত করছে।
বহু জমিদাতা তাঁদের জমি শিল্পের জন্য দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই শিল্প আজও গড়ে ওঠেনি, ফলে জমিদাতারা কাজ থেকেও বঞ্চিত।
শঙ্খ কর্মকার তাঁর বক্তব্যে বলেন, বেকারত্ব এবং মাদক—এই দুটি সমস্যাই সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে।
যুবসমাজ যদি একত্রিত না হয় তবে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হবে। জেলা সভাপতি সন্তোষ গড়াই বলেন, এই দাবিগুলি সাধারণ মানুষের দাবি।
যুবকরা আজ রাস্তায় নেমেছেন সমাজের উন্নতির জন্য। বক্তৃতাগুলিতে ছিল আবেগ, দৃঢ়তা এবং আশার আলো, যা উপস্থিত যুবকদের মনে আরও উৎসাহ যোগায়।
📜 ডেপুটেশন জমা ও প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
বিক্ষোভ শেষে এআইডিও-র চার সদস্যের প্রতিনিধি দল জেলা শাসকের দপ্তরে প্রবেশ করে তাঁদের দাবির তালিকা লিখিতভাবে জমা দেন।
সেখানে উপস্থিত ডেপুটি মেজিস্ট্রেট মনোযোগ দিয়ে তাঁদের দাবি শোনেন। তিনি দাবিগুলির যৌক্তিকতা স্বীকার করেন এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
তবে যুব সংগঠন এখানেই থেমে নেই। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে দাবিগুলি পূরণ না হলে ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।
তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই আন্দোলন শুধুমাত্র একদিনের কর্মসূচি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের অংশ।
🧑🤝🧑 সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া ও সমর্থন
এই বিক্ষোভ-ডেপুটেশনের প্রভাব শুধু যুব সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে।
পথচারী, স্থানীয় দোকানদার, এমনকি সাধারণ শ্রমজীবীরাও আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।
অনেকেই বলেছেন—“আমাদের ছেলেমেয়েরা কাজের অভাবে রাজ্য ছেড়ে ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছে। এটা জেলার জন্য লজ্জার বিষয়।”
কেউ কেউ জানিয়েছেন, “মাদকবিরোধী দাবি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। গ্রামেগঞ্জে নেশার কারণে পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, যুব সমাজ নষ্ট হচ্ছে।”
এই সমর্থন যুব সংগঠনের আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন, দাবিগুলি শুধু যুবকদের নয়, তাঁদের নিজেদের জীবন-জীবিকার সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত।
🌍 কেন গুরুত্বপূর্ণ এই আন্দোলন
পুরুলিয়া দীর্ঘদিন ধরেই কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। শিল্পের অভাবে স্থানীয় মানুষ ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
অনেক স্কুল শিক্ষক সংকটে চলছে, ফলে শিক্ষার মান ক্রমেই নীচে নামছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক বা যন্ত্রপাতি নেই।
অন্যদিকে মাদক সমস্যার কারণে যুব সমাজ বিপথে যাচ্ছে। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতেই এআইডিও-র সাত দফা দাবি অত্যন্ত সময়োপযোগী ও ন্যায্য।
দাবিগুলি পূরণ হলে শুধু যুব সমাজ নয়, জেলার সামগ্রিক উন্নয়ন হবে।
কর্মসংস্থান বাড়লে অর্থনীতি উন্নত হবে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান উন্নত হলে মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়বে, আর মাদক বন্ধ হলে সমাজ সুস্থ পথে এগোবে। তাই আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
🔮 আগামী দিনের লড়াইয়ের ইঙ্গিত
আন্দোলন শেষে যুব সংগঠনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে—এই আন্দোলন এখানেই থামছে না।
যদি দ্রুত দাবিগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আরও বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
যুবকদের স্লোগান ছিল—“আমরা হাল ছাড়ব না, কাজ না পাওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে।”
এই বার্তাই প্রমাণ করছে যে পুরুলিয়ার যুব সমাজ এখন নতুন এক সংগ্রামের পথে হাঁটতে প্রস্তুত।
তাঁদের লক্ষ্য শুধু নিজের চাকরি নয়, বরং সমগ্র জেলার উন্নয়ন। আগামী দিনে পুরুলিয়ার রাজপথ আরও একাধিক আন্দোলনের সাক্ষী হতে পারে, যদি দাবিগুলি পূরণ না হয়।