পুরুলিয়ায় করম পরব ২০২৫।

পুরুলিয়ার রেনী রোডের চন্ডী মাঠে মাহালী সমাজের ঐতিহ্যবাহী করম পরব মহা উৎসাহে পালিত হলো। 

প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু হয় এই উৎসব, যেখানে কুমারী মেয়েরা জাওয়ার ডালি সাজায়, করম ডাল পূজা করে, আর সুরেলা করম গানে মেতে ওঠে। 

ঢোলের তালে করম নাচে যোগ দেন নারী-পুরুষ সবাই। শুধু মাহালী সমাজ নয়, আশেপাশের অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মহিলাদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। 

করম পরব শুধু একটি প্রথা নয়, এটি প্রকৃতি, কৃষি ও জীবনের সমৃদ্ধির প্রতীক। জানুন করম উৎসবের ইতিহাস, রীতি, গান-নাচ এবং আবেগময় মুহূর্তের গল্প। 🌾✨


purulia karm parab

🌾 সাবেকিয়ানায় করম পরব পুরুলিয়ার মাহালী সমাজের মহা উৎসব

পুরুলিয়া জেলা বরাবরই তার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং লোকজ উৎসবের জন্য বিখ্যাত। এই জেলার মানুষজনের জীবনে উৎসব মানেই আনন্দ, একতার প্রতীক। 

এর মধ্যে করম পরব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদযাপন যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। 

এবছরও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে মহা উৎসাহে করম উৎসব পালিত হলো বঙ্গীয় আদিবাসী মাহালী সমাজের উদ্যোগে। 

পুরুলিয়া শহরের রেনী রোডের খেলার চন্ডী মাঠ এবারের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেই মাঠে ছিল উৎসবের আমেজ। 

নারী, পুরুষ, শিশু, যুবক—সবাই মেতে উঠেছিলেন এই উৎসবের আনন্দে। 

শুধু মাহালী সমাজ নয়, আশেপাশের অন্যান্য আদিবাসী ও হরিজন গোষ্ঠীর মহিলাদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। 

তাদের হাসি, আনন্দের উচ্ছ্বাস আর করম গানের সুরে চারপাশ ভরে গিয়েছিল এক অপূর্ব আবহে।


✨ করম পরবের ইতিহাস এবং তাৎপর্য

করম পরবের শেকড় সুদূর অতীতে প্রোথিত। গবেষণা থেকে জানা যায় যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীরাই প্রথম বীজ অঙ্কুরোদগমের ধারণা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেছিল। 

তখনকার সময়ে কৃষি সভ্যতা গড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। 

করম পরবের মূল দর্শন সেই সম্পর্ককে সম্মান জানানো। প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, উর্বর জমি ও ফসলের সমৃদ্ধির প্রার্থনা করা—এসবই এই উৎসবের অন্তর্নিহিত বার্তা। 

করম গাছের ডালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পুরো আয়োজন, কারণ এই ডাল জীবনের প্রতীক, নবজন্মের প্রতীক, আর কৃষির সাফল্যের প্রতীক। 

প্রাচীনকালে যখন মানুষ প্রকৃতিকে পূজা করত, তখন থেকেই করম উৎসবের সূচনা। সেই ঐতিহ্য আজও একই উন্মাদনা নিয়ে পালিত হয়। 

এই উৎসব শুধু এক দিনের নয়, বরং এটি জীবনের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি এক অমলিন শ্রদ্ধাঞ্জলি।


🌿 করম পরবের প্রস্তুতি এবং রীতি

করম একাদশীর সাত দিন আগে থেকেই শুরু হয় করম পরবের প্রস্তুতি। এই সময়টা বিশেষত কুমারী মেয়েদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 

তারা শুদ্ধাচার মেনে হাতে সোহাগে লালিত করে জাওয়ার ডালি। প্রতিটি ডালি যত্নে রাখা হয়, কারণ এটি করম গাছের ডালের সঙ্গে যুক্ত হয়। 

এরপর করম গাছের ডাল সাজানো হয় নানা ফুল, পাতা ও রঙিন সুতো দিয়ে। এই সমস্ত আয়োজনের মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রাচীন লোকসংস্কৃতির ছোঁয়া। 

উৎসবের দিন সকাল থেকেই মানুষ উপবাস করে করম গাছের পূজা করে। তারা অর্ঘ্য প্রদান, করম গান গাওয়া, এবং করম নাচে অংশ নেয়। 

হাতে হাত ধরে বৃত্তে দাঁড়িয়ে সবাই একসঙ্গে নাচ শুরু করে। ঢোলের তালে, করম গানের সুরে আর বাঁশির মিষ্টি সঙ্গতে সৃষ্টি হয় অপূর্ব পরিবেশ। 

এই আয়োজন শুধু আনন্দের জন্য নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চিরন্তন বন্ধনের প্রতীক।


🎉 এবারের করম পরবের মূল অনুষ্ঠান

এবারের করম পরবের মূল অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে পুরুলিয়া শহরের রেনী রোডের খেলার চন্ডী মাঠে। ভোর থেকেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি। 

গ্রামের কিশোরী মেয়েরা খালি গলায় করম গান গাইতে গাইতে মাঠে এসেছিল। দুপুরের পর থেকে জমে ওঠে মূল অনুষ্ঠান। 

নারী-পুরুষ সবাই বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে করম নাচ শুরু করে। ঢোলের বাজনা, করম গানের সুর আর মানুষের উচ্ছ্বাসে চন্ডী মাঠ যেন আনন্দে ভরে ওঠে। 

সন্ধ্যা অব্দি চলে এই উল্লাস। যারা অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিলেন, তারা নিজেরাও করম গানের সুরে পা মিলিয়েছেন। 

শুধু স্থানীয় মানুষই নয়, আশেপাশের এলাকা থেকেও বহু মানুষ এই উৎসব দেখতে এসেছিলেন। তাদের উপস্থিতি এই আয়োজনকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।


🙌 উপস্থিতি এবং বিশিষ্ট অতিথিরা

এই অনুষ্ঠানে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন। সংগঠনের সভাপতি মথুর চন্দ্র মাহালী, সমাজকর্মী দীনবন্ধু মাহালীসহ বনমালী মাহালী, মালবিকা মাহালী, আশালতা মাহালী, অর্চনা মাহালী, কল্পনা মাহালী প্রমুখ সকলে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। 

তাদের উপস্থিতি শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং সমাজের ঐক্যের প্রতীক। তারা সকলেই একবাক্যে বলেন—এই উৎসব শুধু একটি প্রথা নয়, এটি আমাদের শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। 

তাই এই উৎসবকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। তাদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে ঐক্য, আবেগ এবং ঐতিহ্য ধরে রাখার অঙ্গীকার।


🎶 করম গান ও নাচের আবেগ

করম উৎসব মানেই করম গান ও করম নাচের সমাহার। কুমারী মেয়েরা করম গানের সুরে মেতে ওঠে, তাদের কণ্ঠে ভেসে আসে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার বার্তা। 

গানের কথায় থাকে কৃষির সমৃদ্ধির প্রার্থনা, সমাজের ঐক্যের কথা। ঢোলের তালে, বাঁশির সুরে সবাই হাত ধরে বৃত্তাকারে নাচ শুরু করে। 

করম নাচ শুধু একটি বিনোদন নয়, এটি প্রাচীন সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করে। 

এই মুহূর্তগুলো মানুষকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে, ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেয়। সত্যিই, করম গান ও করম নাচের আবেগে ভেসে না গিয়ে থাকা কঠিন।


🌏 করম পরবের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং ভবিষ্যৎ

করম পরব কেবল একটি উৎসব নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়। আধুনিকতার চাপে যখন বহু লোকজ প্রথা বিলীন হয়ে যাচ্ছে, করম উৎসব এখনও টিকে আছে মানুষের মনে। 

এটি শেখায় সম্মিলিতভাবে আনন্দ ভাগাভাগি করা, প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকা, এবং ঐক্যের বার্তা বহন করা। 

আগামী দিনে এই উৎসবকে ধরে রাখা সহজ হবে না, কিন্তু পুরুলিয়ার মানুষদের উৎসাহ দেখে মনে হয় করম পরব শুধু টিকে থাকবে না, বরং আরও বিস্তৃত হবে। 

নতুন প্রজন্মের কাছে এই উৎসবের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে—আমাদের শিকড় ভোলা চলবে না, কারণ শিকড় থেকেই জন্ম নেয় গাছ, আর গাছ থেকেই আসে জীবন।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url