পুরুলিয়ায় মা মনসা পূজা ২০২৫।
🙏পুরুলিয়ার রুক্ষ ভূমিতেও শ্রাবণ সংক্রান্তির মা মনসা পূজা ভক্তির জোয়ার তুলেছে। জানুন এই লোকপূজার ইতিহাস, গুরুত্ব ও অনন্য ঐতিহ্যের গল্প।
পুরুলিয়ায় মা মনসা পূজা ২০২৫ – ভক্তি, ঐতিহ্য ও উন্মাদনার গল্প
🙏 “জয় জয় মা মনসা, জয় বিষহরি গো...”
এ যেন ভক্তির ঢেউ ছুঁয়ে যাচ্ছে পুরুলিয়ার শুষ্ক মাটিকেও। শ্রাবণ মাসের পবিত্র রবিবার, সংক্রান্তির সেই সন্ধ্যা পুরুলিয়ায় এক অন্য আবহ তৈরি করে।
চারিদিকে মন্ত্রধ্বনি, ধূপ-ধুনোর গন্ধ, শঙ্খের আওয়াজে মুখরিত শহর। মা মনসা দেবীর পূজা পরিক্রমা ২০২৫-এ পুরুলিয়ার মানুষ যেমন আনন্দে মেতেছে, তেমনি ভক্তির আবেগে ভরপুর হয়েছে প্রতিটি পাড়া-মহল্লা।
✨ পুরুলিয়ার মাটি ও মনসা পূজার গভীর সম্পর্ক
পুরুলিয়া জেলা মূলত রুক্ষ, শুষ্ক, পাহাড়ি ও লালমাটির দেশ। কৃষি, পরিশ্রম ও প্রকৃতির সঙ্গে যাদের দিন কাটে, তাদের জীবনে ভরসা একটাই – দেবীশক্তি।
আর সাপের ভয় যেখানে বাস্তব, সেখানে সাপের দেবী মা মনসা হয়ে উঠেছেন ভক্তদের রক্ষাকবচ।
মা মনসা পূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি মানুষের বিশ্বাস, লোকসংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার অংশ। বাংলার গ্রামীণ জীবনে যেমন এই পূজা গুরুত্বপূর্ণ, পুরুলিয়াতেও তা সমানভাবে মান্য।
মা মনসা কে? তাঁর পূজার গুরুত্ব কী?
🐍 মনসা দেবী – সাপের দেবী বা নাগদেবী
মনসা দেবীকে “বিষহরী” নামেও ডাকা হয়। কেননা তিনি বিষ (বিশ) নাশ করেন। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, যিনি মা মনসার ভক্তি করেন, তিনি সাপের ভয় থেকে মুক্তি পান এবং সংসারে সুখ-শান্তি বজায় থাকে।
মনসা পূজার প্রধান উদ্দেশ্য:
✅ সাপের দংশন থেকে রক্ষা
✅ ধন-সম্পদের বৃদ্ধি
✅ সন্তান রক্ষা ও দীর্ঘায়ু কামনা
🌿 কখন ও কীভাবে হয় মনসা পূজা?
বিশেষত শ্রাবণ মাসে এই পূজা পালিত হয়। গ্রামে গাছতলায়, উঠোনে বা বাড়ির কোণে সাদামাটা সাজে মনসার পূজা হয়।
অনেক সময় মাটির প্রতিমা, কখনও সাপের প্রতীক আঁকিয়েও পূজা করা হয়। ধূপ, প্রদীপ, ফুল, দুধ, চিঁড়ে, কলা ইত্যাদি দিয়ে মা মনসাকে সন্তুষ্ট করা হয়।
মা মনসার পূজার পৌরাণিক ইতিহাস – চাঁদ সৌদাগর ও বেহুলার গল্প
💫 পুরাণের সেই অমর কাহিনি:
শিবের কন্যা মনসা দেবী। দেবলোক তাঁকে গ্রহণ করলেও, মানুষ তাঁর পূজা মানেনি। তখন মনসা মানুষের মধ্যে নিজের পূজা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা শুরু করেন।
📖 চাঁদ সৌদাগরের গল্প:
চাঁদ সৌদাগর ছিলেন ধনবান ব্যবসায়ী এবং শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি মনসার পূজা করতে অস্বীকার করেন। এতে মনসা ক্রুদ্ধ হয়ে চাঁদের পরিবারকে বিপদে ফেলেন।
-
তাঁর ছয় ছেলেকে সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়।
-
একমাত্র ছোট ছেলে লক্ষীন্দর বেঁচে ছিল।
কিন্তু বিয়ের রাতেই সাপের দংশনে লক্ষীন্দরের মৃত্যু হয়।
💔 বেহুলার ভক্তি ও সংগ্রাম:
স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে বেহুলা স্বর্গলোকে যাত্রা করেন। তিনি দেবতাদের তুষ্ট করেন এবং ভক্তির জোরে মনসার মন জয় করেন। শেষে মনসা লক্ষীন্দরকে জীবন ফিরিয়ে দেন। চাঁদ সৌদাগরও বাধ্য হয়ে মনসার পূজা মানেন।
👉 এই গল্প থেকেই মনসা পূজার ঐতিহ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
পুরুলিয়ায় মনসা পূজা ২০২৫ – উৎসবের আবহ
🌸 শহর জুড়ে উন্মাদনা:
গতকাল পুরুলিয়া শহরের বিভিন্ন প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পুজো কমিটি পরিক্রমায় বের হয়েছিল। রঙিন আলোকসজ্জা, ঢাকের শব্দ, শঙ্খধ্বনি—সব মিলিয়ে শহর যেন উৎসবের সাজে সেজে উঠেছিল।
🎶 গানে গানে ভক্তি:
“জয় জয় মা মনসা, জয় বিষহরি গো...”—এই গান গেয়ে ভক্তরা মেতে ওঠেন। ছোট থেকে বড়, সবাই মিছিলের অংশ হয়ে দেবীর গুণকীর্তনে ভরিয়ে তোলে রাস্তা।
📸 ভক্তদের আবেগ:
অসংখ্য মানুষ প্রণাম ও ফুলের থালা নিয়ে দেবীর দর্শনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেকেই মাটির প্রতিমার সামনে সাপের ছবি এঁকে পুজো করেছেন।
পুরুলিয়ার এই লোক উৎসব কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সামাজিক মিলনমেলাও।
কেন আজও সমান জনপ্রিয় মনসা পূজা?
✅ সাপের ভয় আজও গ্রামীণ জীবনে বড় বাস্তবতা।
✅ পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে লোকসংস্কৃতি ও আবেগ।
✅ ভক্তরা বিশ্বাস করেন, মনসা কৃপা করলে জীবনে শান্তি আসে।
🌼 তাই পুরুলিয়া থেকে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, ঝাড়খণ্ডের গ্রাম পর্যন্ত মনসা পূজার জোয়ার ছড়িয়ে পড়ে প্রতি বছর।
📌 গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এক নজরে:
বিষয় | তথ্য | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|
দেবীর নাম | মনসা দেবী (বিষহরী, পদ্মাবতী) | |||||||
পূজার সময় | শ্রাবণ মাস | |||||||
প্রধান উদ্দেশ্য | সাপের ভয় থেকে মুক্তি, সুখ-শান্তি কামনা | |||||||
পূজার উপকরণ | ধূপ, প্রদীপ, দুধ, কলা, ফুল, চিঁড়ে | |||||||
পূজার ধরন | গাছতলায়, উঠোনে বা প্রতিমার সামনে |
পুরুলিয়ার জন্য এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
মনসা পূজা কেবল একটি লোকধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। এটি পুরুলিয়ার মানুষের জীবনের অংশ, যেখান থেকে তারা পায় সাহস, বিশ্বাস এবং একতার শক্তি।
ভক্তদের চোখে আজও মনসা দেবী শুধু সাপের দেবী নন, তিনি হলেন আশ্রয়, আশা ও আধ্যাত্মিক শান্তির প্রতীক।
🙏 জয় জয় মা মনসা!