বান্দোয়ান দুর্গাপুজোয় ওসির অনন্য সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত।

পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের বান্দোয়ানে দুর্গাপুজোয় মহাঅষ্টমীর শেষে দেখা গেল এক অনন্য দৃশ্য। 

থানার ওসি শেখ মুমতাজ সাদা ধুতি-গেঞ্জি পরে, কাঁধে লাল গামছা নিয়ে খালি পায়ে হাতে নিলেন বলিদানের তলোয়ার। 

তবে রক্ত ঝরেনি, বরং লাল গামছায় মুড়ে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিলেন তিনি। প্রায় ৯০ বছরের পুরনো এই প্রথায় প্রাণী বলি নেই, চালকুমড়ো ও আখ দিয়েই চলে রীতি। 

বিশ্বাস করা হয়, এভাবে উগ্রতাকে প্রশমিত করা হয়। ভিন্ন ধর্মের অফিসার হয়েও শেখ মুমতাজের অংশগ্রহণ বান্দোয়ানের মানুষকে আবেগাপ্লুত করেছে। 

একসময় মাওবাদী আতঙ্কে ভরা এই জঙ্গলমহল আজ শান্তি ও মানবতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। 

স্থানীয় পুজো কমিটি ও মানুষের মতে, এটাই সম্প্রীতির প্রকৃত উদাহরণ এবং কমিউনিটি পুলিশিং-এর সেরা রূপ। দুর্গোৎসবের এই ছবি প্রমাণ করেছে—ধর্ম ভিন্ন হলেও মানবতা-ই সর্বশ্রেষ্ঠ।


lal gamcha talowar bandwan

লাল গামছায় ঢাকা বলিদানের তলোয়ার: বান্দোয়ানে শান্তি ও সম্প্রীতির জয়গান 🕊️✨


দুর্গাপুজোর ভিড়ে এক অনন্য দৃশ্য 🎉

শারদোৎসব মানেই আলোকসজ্জা, ঢাকের আওয়াজ, প্রতিমার সামনে মানুষের ঢল আর আনন্দমুখর পরিবেশ। 

কিন্তু পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের বান্দোয়ানে এ বছরের দুর্গাপুজোয় দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ছবি। 

মহাঅষ্টমীর সন্ধিপুজো শেষে থানার অফিসার ইন চার্জ (ওসি) শেখ মুমতাজ হাতে তুলে নিলেন বলিদানের তলোয়ার। তবে রক্ত ঝরেনি। 

বরং লাল গামছা দিয়ে মুড়ে দিলেন সেই তলোয়ার। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।

বলিদানের জায়গায় শান্তির এই প্রতীক হয়ে উঠল উৎসবের মূল আকর্ষণ। 

সাধারণত পুজোয় বলি মানেই আতঙ্কের ছবি, কিন্তু এখানে তা উল্টে গিয়েছে। এখান থেকে ছড়িয়েছে একটাই বার্তা—“ধর্ম ভিন্ন হলেও মানবতা বড়।”

এই দৃশ্য প্রমাণ করে, জঙ্গলমহল যেটি একসময় ভয় ও অশান্তির কেন্দ্র ছিল, আজ সেখানে শান্তি ও সম্প্রীতির জয়গান গাওয়া হচ্ছে। 

ওসির এই পদক্ষেপ মানুষকে শুধু আবেগাপ্লুত করেনি, বরং প্রমাণ করেছে—পুলিশও জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একসাথে উৎসব করতে পারে।


৯০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের গল্প 🌸

বান্দোয়ানের এই দুর্গাপুজো শুধু আজকের নয়, এর রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। প্রায় ৯০ বছর আগে থেকেই এখানে মহাঅষ্টমীর সন্ধিপুজোর শেষে একটি বিশেষ প্রথা চলে আসছে। 

বলিদানের জন্য ব্যবহৃত তলোয়ার থানায় নিয়ে গিয়ে ওসি নিজে সেটিকে লাল গামছায় মুড়ে দেন। এভাবেই উগ্রতাকে প্রশমিত করার প্রতীকী বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়।

পুজো কমিটির প্রবীণ সদস্য অমিত আগরওয়াল বলেন—

“আমাদের পুজোয় কোনও দিন প্রাণী বলি হয়নি। বরং চালকুমড়ো ও আখ দিয়েই বলির প্রথা চলে আসছে। হয়তো মানুষের ভেতরের উগ্রতাকে প্রশমিত করতেই এই নিয়ম ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে।”

এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, বান্দোয়ানের মানুষ ধর্মীয় রীতি মানলেও তা সবসময় মানবিক দিককে প্রাধান্য দিয়েছে। 

বলিদানকে রক্তহীন করার এই অনন্য উদ্যোগ আজও বহমান। এ যেন পুরুলিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত এক মূল্যবান সম্পদ।


ভিন্ন ধর্মের ওসি-র মানবিক অংশগ্রহণ ✨

এবারের দুর্গাপুজোর বিশেষ আকর্ষণ ছিল থানার ওসি শেখ মুমতাজের অংশগ্রহণ। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেই আগ্রহ দেখিয়ে এই ঐতিহ্যে শামিল হন। 

সাদা ধুতি-গেঞ্জি পরে, কাঁধে লাল গামছা নিয়ে খালি পায়ে তিনি বলিদানের সেই তলোয়ার তুলে নেন। এরপর লাল গামছা দিয়ে সেটি মুড়ে দেন, যেন উগ্রতার ওপর শান্তির জয়গান।

অমিত আগরওয়ালের কথায়—

“একটাই তো ধর্ম—মানবতা। সেটাই এখানে প্রতিফলিত হয়েছে।”

ওসি শেখ মুমতাজও আবেগ প্রকাশ করে বলেন—

“আমি বান্দোয়ানের ওসি। এখানে যে রীতি বহুদিন ধরে চলে আসছে, সেটি পালন করেছি। এর আসল উদ্দেশ্য শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।”

মানুষ দেখল, একজন পুলিশ অফিসার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দাঁড়াতে পারেন। তার এই পদক্ষেপ স্থানীয়দের মধ্যে আস্থা, ভালোবাসা আর ঐক্যের নতুন অধ্যায় লিখে দিল।


নব দুর্গা কমিটির ১৫ বছরের রীতি 🌼

২০১১ সালে পুরোনো পুজো কমিটি ভেঙে গড়ে ওঠে বান্দোয়ান নব দুর্গা সর্বজনীন কমিটি। এই নতুন কমিটিও বিগত ১৫ বছর ধরে একই রীতি পালন করে আসছে। 

তারা বিশ্বাস করে, বলিদানের তলোয়ারকে থানায় নিয়ে গিয়ে ওসির হাতে লাল গামছায় মুড়ে দেওয়া মানেই উগ্রতা কমানো ও শান্তি ছড়িয়ে দেওয়া।

কমিটির সদস্য সঞ্জয় হালদার বলেন—

“আমাদের পুজোতে কখনও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ছিল না। এবারের আঁকা প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া শিশুটি ভিন্ন ধর্মের হলেও সবাই আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করেছে। ওসি সাহেব নিজে জানতে চান, তিনি কি এই প্রথায় অংশ নিতে পারেন। আমরা বলেছি—কেন নয়? এটাই তো সম্প্রীতির উদাহরণ।”

এই বক্তব্য প্রমাণ করে, বান্দোয়ান কেবল দুর্গাপুজোর স্থান নয়, বরং এটি এক অনন্য সামাজিক মিলনমেলা। এখানে ধর্মের দেওয়াল ভেঙে মানুষ একে অপরের হাত ধরে উৎসব পালন করে।


জগজ্জননীর সামনে অভিনব পরীক্ষা 🌺

বান্দোয়ান নব দুর্গা পুজোর আরও একটি বিশেষ রীতি রয়েছে, যেটি অন্য কোথাও সচরাচর দেখা যায় না। সেটি হলো—মায়ের সামনে ‘ফুল পরীক্ষা’। 

ভক্তরা দেবীর কাছে ফুল চান, আর বিশ্বাস করা হয় দেবী নিজে সেই ফুল ভক্তদের হাতে দেন।

এই রীতি কেবল আধ্যাত্মিক দিকেই নয়, সমাজের ভেতরে ভক্তি ও মানবতার মেলবন্ধনের প্রতীক। এখানে ভক্তি ও বিশ্বাস একে অপরকে সম্পূর্ণ করে তোলে।

এমন অনন্য প্রথা মানুষকে দেবী আরাধনার পাশাপাশি শেখায়—বিশ্বাস মানেই শান্তি, ভক্তি মানেই ভালোবাসা। 

এই কারণেই বান্দোয়ানের পুজো স্থানীয় মানুষের হৃদয়ে এক বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছে।


জঙ্গলমহলের পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি 🌿🔫➡️🕊️

যে বান্দোয়ান একসময় মাওবাদী আন্দোলনের জন্য পরিচিত ছিল, সেখানে আজ শান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে লাল গামছায় মোড়ানো বলিদানের তলোয়ার। 

অতীতে এই এলাকা ভয়, অশান্তি আর সংঘর্ষের কেন্দ্র ছিল। কিন্তু আজ সেই স্থান শান্তি, ঐক্য আর সম্প্রীতির প্রতীক।

👉 একসময় যেখানে মানুষ আতঙ্কে ভুগত, আজ সেখানে হাজার মানুষ ভিড় জমান শান্তির বার্তা দেখতে।
👉 থানার দরজা খোলা থাকে, কেউ কোনও প্রশ্ন করেন না।
👉 উৎসবের দিনে পুলিশ কেবল আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী নয়, বরং উৎসবের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।

এই পরিবর্তন কেবল প্রশাসনের সাফল্য নয়, বরং মানুষের মধ্যে নতুন আস্থা ও সম্পর্কের প্রতীক।


পুলিশের মানবিক মুখ ✨👮

ওসি শেখ মুমতাজের এই পদক্ষেপ প্রমাণ করেছে—পুলিশ কেবল আইন রক্ষাকারী নয়, বরং সমাজের বন্ধু। 

যখন একজন ওসি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্থানীয় মানুষের প্রথায় অংশ নেন, তখন জনগণ ও পুলিশের দূরত্ব অনেকটাই কমে যায়।

👉 এটি কমিউনিটি পুলিশিং-এর সেরা উদাহরণ।
👉 মানুষের মনে পুলিশের প্রতি আস্থা বাড়ে।
👉 সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা জোরদার হয়।

অনেকেই বলছেন, এটি জঙ্গলমহলের এক নতুন পাঠ। পুলিশ-জনগণের সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করার অনন্য প্রয়াস।


মূল বার্তা: শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতা 🌍💖

বান্দোয়ানের এই প্রথা আমাদের শেখায়—

  • ধর্ম ভিন্ন হলেও মানবতার জয় সর্বদা বড়।

  • রক্ত নয়, শান্তি দিয়েই উগ্রতাকে প্রশমিত করা যায়।

  • পুলিশ কেবল শাসক নয়, বরং মানুষের বন্ধু।

  • উৎসব কেবল আনন্দের নয়, বরং ঐক্যের প্রতীক।

এটি সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। আজকের বিভেদের পৃথিবীতে এই বার্তা আরও জরুরি।


উপসংহার 🙏

পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের দুর্গাপুজো কেবল দেবী আরাধনার উৎসব নয়, এটি শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার প্রতীক। 

একদিকে ৯০ বছরের পুরনো ঐতিহ্য, অন্যদিকে আধুনিক পুলিশ প্রশাসনের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি—দুটির মেলবন্ধনে জন্ম নিয়েছে অনন্য উদাহরণ।

লাল গামছায় ঢাকা তলোয়ার এখন শুধু একটি প্রথা নয়, বরং জঙ্গলমহলের শান্তি, ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রতীক। এই উদ্যোগ আজকের প্রজন্মকে শেখাচ্ছে—মানবতা-ই সর্বোচ্চ ধর্ম। 🌿🕊️


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url