জাপানে নাটুয়ার নাচে পুরুলিয়ার জয়।
পুরুলিয়ার বলরামপুরের পাঁড়দ্দা গ্রামের চার নাটুয়া শিল্পী বিশ্বমঞ্চে তুললেন বাংলার গর্ব। জাপানের ওসাকা শহরে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২৫–এ তাঁদের অসাধারণ নাটুয়া নৃত্য মুগ্ধ করল বিদেশি দর্শককে।
শক্তি, আবেগ আর মাটির টানে ভরা এই নাচ প্রথমে অনেকেই ছৌ ভেবেছিলেন, কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁরা বুঝলেন নাটুয়ার আলাদা জাদু।
অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, নেপালসহ ১৪টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধি নাটুয়া শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানান। দেশে ফিরে গ্রামবাসীরা ঢাক–ঢোল আর উল্লাসে তাঁদের বরণ করেন।
শিল্পীদের এই জয় শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং বাংলার লোকসংস্কৃতির আন্তর্জাতিক পরিচয়ের এক গর্বিত অধ্যায়।
🎭 জাপানে নাটুয়ার বিশ্বজয় | পুরুলিয়ার শিল্পীদের অনন্য সাফল্য
🌍 বিশ্বমঞ্চে নাটুয়ার গৌরব
বাংলার মাটি থেকে উঠে আসা লোকসংস্কৃতি কতটা শক্তিশালী হতে পারে, তার প্রমাণ মিলল জাপানের ওসাকা শহরে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২৫–এ।
পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের সেই আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উৎসবে পুরুলিয়ার চারজন নাটুয়া শিল্পী তাঁদের বীরত্বগাথা মিশ্রিত নৃত্যশৈলী প্রদর্শন করলেন, আর মুহূর্তের মধ্যেই মুগ্ধ করলেন বিশ্ব দর্শককে।
এই নাচ শুধু একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নয়, এটি ছিল একরকম আত্মপরিচয় প্রদর্শনের মুহূর্ত।
জাপানের মঞ্চে যখন ছন্দে ছন্দে তাঁদের পদক্ষেপ পড়ছিল, তখন কেবল বীরত্বই নয়, মিশে যাচ্ছিল আবেগ, শক্তি আর বাংলার মাটির টান।
ওসাকার আন্তর্জাতিক অডিটোরিয়ামে উপস্থিত দর্শকেরা প্রথমে এই নাচকে ছৌ ভেবে ভুল করেছিলেন।
কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরা বুঝলেন, নাটুয়া আলাদা, এটি শক্তি, উদ্দীপনা এবং ঐতিহ্যের এমন এক মিশ্রণ, যার আবেদন সর্বজনীন।
পুরুলিয়ার ছোট্ট বলরামপুরের পাঁড়দ্দা গ্রামের শিল্পীরা যখন তাঁদের প্রতিভার ঝলক দেখাচ্ছিলেন, তখন দর্শকের করতালিতে যেন গোটা বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধ্বনিত হচ্ছিল।
তাঁদের সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দিল, যে কোনো স্থানীয় সংস্কৃতির শক্তি যদি সঠিক মঞ্চ পায়, তবে তা বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিতে দেরি হয় না।
🎶 সংস্কৃতির সেতুবন্ধনে নাটুয়ার ছন্দ
২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত চলা এই বিশ্বমেলায় ১৬৮টি দেশ অংশ নেয়। প্রতিটি দেশই নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরেছিল রঙিন সাজে ও চমকপ্রদ উপস্থাপনায়।
সেই ভিড়ের মধ্যেই নাটুয়ার আবির্ভাব ছিল একেবারেই ভিন্ন মাত্রার। নাটুয়া নাচ মূলত গ্রামীণ বাংলার এক বিশেষ লোকনৃত্য, যা শক্তি ও বীরত্বের প্রতীক।
বিদেশি দর্শকেরা প্রথমে একে ছৌ নাচ ভেবেছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা নাটুয়ার আসল রূপ চিনতে পারেন।
নাটুয়ার প্রতিটি ভঙ্গিতে শক্তি, প্রতিটি ছন্দে আবেগ, আর প্রতিটি মুদ্রায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের উপস্থিতি যেন তাঁদেরকে নাড়া দিয়েছিল।
শিল্পী জগন্নাথ কালিন্দী পরে সাংবাদিকদের বলেন, "অনেকেই আগে নাটুয়া চিনতেন না। কেউ কেউ ছৌ ভেবেছিলেন। কিন্তু যখন আবেগ ও বীরত্ব মিশ্রিত এই নাচ তাঁদের চোখের সামনে ফুটে উঠল, তখন তাঁরা বিস্মিত হয়ে গেলেন।"
অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, নেপালসহ অন্তত ১৪টি দেশের প্রতিনিধি এই নাচকে ভবিষ্যতে নিজেদের দেশে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন।
এর মানে হলো, নাটুয়ার এই পরিবেশনা শুধু একটি অনুষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকল না, বরং এটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের এক সেতুবন্ধন হয়ে উঠল।
🏆 গ্রামে ফিরে উল্লাসের ঢেউ
জাপান জয় করে দেশে ফিরতেই পুরুলিয়ার পাঁড়দ্দা গ্রামে সৃষ্টি হয় উৎসবের পরিবেশ। গ্রামবাসীরা যেন অপেক্ষায় ছিলেন নিজেদের সন্তানদের জয়যাত্রার গল্প শোনার জন্য।
গ্রামের চার শিল্পী যখন ফিরে আসেন, তখন বাজনা, ঢাক, কাঁসর, উল্লাস আর মালার বৃষ্টি দিয়ে তাঁদের বরণ করা হয়।
ছোট ছোট বাচ্চা, কিশোর, যুবক, এমনকি প্রবীণ মানুষও ভিড় জমিয়েছিলেন তাঁদের এক ঝলক দেখার জন্য। আবেগে ভেসে উঠেছিল গোটা গ্রাম।
শুধু তাই নয়, শিল্পীরা ফিরে এসেই প্রথমে মাল্যদান করেন প্রয়াত প্রখ্যাত নাটুয়া শিল্পী হাঁড়িরাম কালিন্দীর আবক্ষ মূর্তিতে।
এই শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রমাণ করে, তাঁরা যতই আন্তর্জাতিক মঞ্চে খ্যাতি অর্জন করুন না কেন, নিজেদের শিকড় ভুলে যাননি। বরং তাঁদের জয় যেন গ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা।
স্থানীয় মানুষের মুখে তখন একটাই কথা শোনা যাচ্ছিল—"আমাদের ছেলেরা প্রমাণ করেছে, ছোট গ্রাম থেকেও বিশ্বজয় সম্ভব।"
আসলে এই সাফল্য শুধু শিল্পীদের নয়, বরং গোটা গ্রাম, গোটা জেলা এবং গোটা বাংলার সম্মান বহন করে।
🙏 শিল্পীদের আবেগঘন মন্তব্য
বিদেশ থেকে ফিরে এসে শিল্পীরা যখন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন, তখন তাঁদের কণ্ঠে ফুটে উঠল এক গভীর আবেগ।
বৈদ্যনাথ মাহাতো বলেন, "দুর্গাপুজোর মতো বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসবের সময়ে বিদেশে গিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে আমরা গর্বিত। চাই, আগামী দিনে আরও অনেক নাটুয়া শিল্পী বিশ্বমঞ্চে নিজের প্রতিভা দেখাক।"
এই কথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। শিল্পীরা জানিয়ে দেন, নাটুয়া নাচকে তাঁরা শুধু নিজেদের শখ বা আনন্দের জায়গা থেকে করেন না, বরং এটি তাঁদের জীবনের পরিচয়।
তাঁদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল গর্ব, অথচ বিনয়ের ছাপও স্পষ্ট ছিল।
তাঁদের আবেগঘন বক্তব্যে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, তাঁরা চান নাটুয়ার এই ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক, যাতে আগামী দিনে আরও অনেক ছেলে-মেয়ে এই শিল্পকে বুকে ধারণ করতে পারে।
তাঁদের এই সাফল্য তাই কেবল একটি বিদেশযাত্রার জয় নয়, বরং আগামী দিনের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিকনির্দেশনা।
🌟 নাটুয়ার বিশেষত্ব ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
নাটুয়ার বিশেষত্ব এখানেই যে, এটি কেবল একটি নৃত্যশৈলী নয়, বরং এটি শক্তি, বীরত্ব, আবেগ এবং ইতিহাসের এক অনন্য সমাহার।
প্রতিটি ভঙ্গিতে যুদ্ধের আবহ, প্রতিটি ছন্দে মাটির টান আর প্রতিটি পদক্ষেপে ঐতিহ্যের গর্ব প্রকাশিত হয়। এ কারণেই বিদেশি দর্শকেরা একে বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন।
ওসাকার মঞ্চে নাটুয়ার সাফল্যের পর ইতিমধ্যেই অন্তত ১৪টি দেশের প্রতিনিধি এই নৃত্যশিল্পকে তাঁদের দেশে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, নেপাল, এমনকি ইউরোপের কয়েকটি দেশও নাটুয়ার প্রতি কৌতূহল দেখিয়েছে।
এর ফলে নাটুয়া ভবিষ্যতে কেবল ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির মানচিত্রে জায়গা করে নেবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে নাটুয়ার শিল্পীদের যথেষ্ট সহায়তা দেওয়া হয়, তবে আগামী দিনে নাটুয়া হতে পারে ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতির অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার।
❤️ উপসংহার গর্বে ভরা এক যাত্রা
পুরুলিয়ার চার নাটুয়া শিল্পীর জাপান জয় কেবল একটি সাফল্যের গল্প নয়, এটি আমাদের শেখায়—ছোট জায়গা থেকে শুরু হলেও, প্রতিভা আর নিষ্ঠা থাকলে বিশ্বজয় করা সম্ভব।
এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হলো, লোকসংস্কৃতি কোনো সীমানায় আটকে থাকে না, এর আবেদন সর্বজনীন।
নাটুয়ার পদক্ষেপ যখন জাপানের মঞ্চে পড়ছিল, তখন তা হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাংলার আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
আমাদের দায়িত্ব হলো এই ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া, যাতে তারা বুঝতে পারে নিজেদের সংস্কৃতির মাহাত্ম্য।
সত্যিই, নাটুয়ার বিশ্বজয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি প্রজন্মের উচিত নিজেদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসা ও লালন করা। 🌺