হাতির হানায় আতঙ্কে পুরুলিয়ার ঝালদা জজহাতু গ্রাম।
পুরুলিয়ার ঝালদা রেঞ্জের জজহাতু গ্রামে প্রায় ১৭টি বুনো হাতির হানায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে গ্রামবাসীরা।
রাতের অন্ধকারে পাহাড় পেরিয়ে হাতির দল গ্রামে ঢুকে ধান, লাউ, বেগুনসহ একাধিক ফসল নষ্ট করে দেয়।
কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি বিপুল, ক্ষতিপূরণের আশায় চোখ রাখছেন সবাই। বন দফতর ও প্রশাসন ঘটনাস্থলে গিয়ে নজরদারি শুরু করেছে এবং হাতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
আতঙ্কের মধ্যেও গ্রামবাসীরা আশায় রয়েছেন— এবার যেন দ্রুত সাহায্য ও নিরাপত্তা পান। 🐘🌾
🐘 হাতির হানায় কাঁপছে পুরুলিয়ার ঝালদা: রাতের অন্ধকারে আতঙ্কে জজহাতু গ্রাম
পুরুলিয়ার পাহাড়তলীর শান্ত গ্রাম জজহাতু সোমবার গভীর রাতে হঠাৎই ত্রাসের রাজ্যে পরিণত হয়।
রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে সিন্ধারিয়া পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে নেমে আসে প্রায় সতেরোটি বুনো হাতির একটি দল।
আকাশে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে, গ্রামের মানুষজন ঘুমিয়ে পড়েছিল, কেবল মাঝে মাঝে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
হঠাৎই পাহাড়ের দিক থেকে গাছপালা ভাঙার শব্দে ঘুম ভাঙে বহু মানুষের। তারপর মুহূর্তের মধ্যে দেখা যায় ধানক্ষেত, লাউগাছ, বেগুনের ক্ষেত চূর্ণবিচূর্ণ। 🌾
গ্রামবাসীরা ভয়ে বাড়ির জানালা বন্ধ করে দেয়, কেউ কেউ চিৎকার করে অন্যদের সতর্ক করে। পুরুষরা শিশু ও মহিলাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে হাতিরা গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তাণ্ডব চালায়। তাদের বিশাল দেহের ওজন ও শক্তিতে এক রাতেই বহু কৃষকের সারাবছরের পরিশ্রম নষ্ট হয়ে যায়।
গ্রামবাসীদের মতে, এই হাতির দলটি প্রতিবছরই আসে, কিন্তু এবার সংখ্যায় অনেক বেশি।
স্থানীয়দের চোখে আতঙ্কের ছাপ, কারও চোখে ক্ষোভ, আবার কারও চোখে নিস্তব্ধ বেদনা— যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চিরন্তন সংঘাতের প্রতিচ্ছবি। 😢
🌾 ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের কান্না: ফসল নষ্ট, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
হাতির তাণ্ডবে গ্রামের অন্তত কুড়ি জন কৃষক ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ধান, লাউ, বেগুন, আলু— কোনও ফসলই রক্ষা পায়নি।
অনেকেই এই মৌসুমের ফসলের জন্য ঋণ নিয়েছিলেন। এখন তাদের কাছে কেবল মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া ফসল আর হতাশার দীর্ঘশ্বাস। পূর্ণচন্দ্র মাহাত নামে এক কৃষক বলেন,
“প্রতি বছর হাতিরা আসে, কিন্তু ক্ষতিপূরণ পেতে মাসের পর মাস লেগে যায়। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের জীবিকা ফসলের ওপর নির্ভর করে। সরকার যেন অন্তত দ্রুত সাহায্য করে।”
তার চোখে জল, কণ্ঠে এক ধরনের ক্লান্তি— যেন প্রকৃতির কাছে পরাজিত মানুষের অসহায় স্বীকারোক্তি।
অন্য এক কৃষক, ধনঞ্জয় মাহাত, বলেন,
“রাতভর মাঠে লাউ, কুমড়ো সব তছনছ করে গেছে। এখন ঘরে চালও ফুরিয়ে আসছে। কিভাবে পরিবার চালাব জানি না।”
গ্রামে এখন প্রতিটি পরিবারের মুখে একটাই কথা— “কখন আসবে ক্ষতিপূরণ?”
মহিলারা ভয়ে রাতে বাইরে বেরোন না, শিশুরা স্কুলে যাওয়ার আগেও আতঙ্কে কাঁপে। এই পরিস্থিতি যেন শুধু ফসলের ক্ষতি নয়, গ্রামবাসীর মানসিক শান্তিরও ক্ষয়।
🌲 বন দফতরের তৎপরতা ও প্রশাসনের ভূমিকা
ঘটনার খবর পাওয়ার পর বন দফতরের আধিকারিকরা সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান। তারা হাতির দলের অবস্থান নির্ণয় করতে ড্রোন ও টর্চলাইট ব্যবহার করেন।
জানা যায়, হাতিরা বর্তমানে ঘসরাপাহাড় এলাকায় অবস্থান করছে এবং তাদের চলাচলের ওপর নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি চলছে। বন দফতরের একজন আধিকারিক জানান,
“আমরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি যাতে হাতিরা আবার গ্রামে না ঢোকে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি হচ্ছে, খুব শীঘ্রই ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া শুরু হবে।”
স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য রবীন্দ্রনাথ মাহাত নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলি পরিদর্শন করেছেন।
তিনি বলেন,
“আমি কৃষকদের পাশে আছি। বন দফতর ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে যাতে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়। মানুষ যেন অন্তত কিছুটা স্বস্তি পায়।” 🌿
প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রামের মানুষকে নিরাপদ স্থানে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছে, হাতি প্রবেশের সম্ভাবনা থাকা এলাকায় অতিরিক্ত পাহারা ও আলো স্থাপন করা হবে। এই পদক্ষেপে কিছুটা হলেও গ্রামবাসীর মনে আশার আলো জ্বলেছে।
🏞️ হাতিদের আগমন ও প্রাকৃতিক কারণ: সংঘাতের মূল বিশ্লেষণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরুলিয়ার মতো পাহাড়ি অঞ্চলে বনাঞ্চল ধীরে ধীরে কমে আসছে। এর ফলে হাতিরা তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল হারাচ্ছে।
খাদ্যের অভাব ও মানুষের বসতি বৃদ্ধির কারণে তারা প্রায়ই গ্রামে চলে আসে। বন দফতরের অভিজ্ঞ কর্মীরা জানান,
“আগে হাতিরা মূলত জঙ্গলেই থাকত, কিন্তু এখন চাষের জমিতেও খাদ্য পায়। ফলে তারা সহজেই গ্রামে ঢুকে পড়ছে।”
এই সমস্যার সমাধানে দরকার দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব—
-
হাতির চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট করিডর পুনর্গঠন করা।
-
ফসল ও বনাঞ্চলের মাঝখানে বাফার জোন তৈরি করা।
-
সৌরচালিত বৈদ্যুতিক বেড়া বসানো।
-
গ্রামীণ সতর্কীকরণ সাইরেন চালু করা।
-
এবং সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করা।
এমন উদ্যোগ নিলে হাতি ও মানুষের সহাবস্থান সম্ভব হবে। প্রকৃতিকে রক্ষা করে গ্রামও নিরাপদ থাকবে— এটাই এখন সবার আশা। 🌏
❤️ গ্রামবাসীর আশা ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
আজ জজহাতু গ্রামে ভয়, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ছায়া। দিন মেলে সূর্যের আলো, কিন্তু মানুষের মনে এখনও সেই রাতের অন্ধকার রয়ে গেছে।
অনেকেই এখন দল বেঁধে পাহারা দেয় রাতে, কেউ কেউ বাড়ির পাশে মশাল জ্বালিয়ে রাখে। ছোট ছোট শিশুরা ঘুমোতে গেলেও প্রশ্ন করে— “আজ হাতি আসবে না তো মা?” 🥺
এই ভয়ের মধ্যেও গ্রামবাসী আশা হারায়নি। তাদের বিশ্বাস, বন দফতর এবার দ্রুত ব্যবস্থা নেবে, ক্ষতিপূরণও মিলবে সময়মতো।
কৃষকেরা আবারও জমি চাষ করবে, আবারও ফসল ফলাবে। প্রকৃতির সঙ্গে এই লড়াই চলবে, কিন্তু তারা হার মানবে না।
গ্রামবাসীর এক তরুণ বলেন,
“আমরা হাতিদের মারতে চাই না। ওরাও তো বাঁচতে চায়। কিন্তু সরকার যদি আমাদের একটু সাহায্য করে, তাহলে আমরা সবাই মিলে সহাবস্থান করতে পারবো।” 🌱
এই ঘটনাটি শুধু একটি গ্রামের নয়, এটি গোটা জেলার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল— মানুষ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা কতটা জরুরি।
