গ্রামের লক্ষ্মীদের সঞ্চয়ে ঝলমলে চেক্যা গ্রামের লক্ষ্মীপূজা।
পুরুলিয়ার চেক্যা গ্রামে সপ্তম বর্ষে আয়োজিত কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা এবারও শহরের ঝলমলে উৎসবকে টেক্কা দিয়েছে।
পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা এই ছোট গ্রামটি কয়েক দিনের জন্য আলোর, রঙের এবং আনন্দের মেলবন্ধনে সাজে উঠেছে।
গ্রামের মহিলারা বছরভর ঝাঁপি ভরে রাখেন, সেই টাকায় হয় দেবী লক্ষ্মীর মহাউৎসব। চার দিন ধরে পালা-কীর্তন, নাটক, সংগীত এবং ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানগুলোতে মেতে ওঠে পুরো গ্রামবাসী।
দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন এই গ্রামীণ উৎসব দেখতে। এটি কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং গ্রামের ঐক্য, ভালোবাসা এবং আত্মনির্ভরতার প্রতীক।
চেক্যা গ্রামের এই পুজো প্রমাণ করে যে আন্তরিকতা এবং ঐক্য থাকলেই গ্রামও শহরের একচেটিয়া আধিপত্য ছাপিয়ে এক অপূর্ব উৎসবের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
🌸 গ্রামের লক্ষ্মীদের ঝাঁপির টাকায় ঝলমলে শহুরে উৎসবকে টেক্কা দিচ্ছে প্রত্যন্ত চেক্যা গ্রামের লক্ষ্মীপূজা
🌼 চেক্যা গ্রামে উৎসবের আবহ
পুরুলিয়ার কোটশিলা অঞ্চলের প্রত্যন্ত চেক্যা গ্রাম যেন কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার সময় এক নতুন পরিচয়ে ধরা দেয়।
পাহাড়-জঙ্গল আর সবুজের বুকে ঘেরা এই ছোট্ট গ্রামটির সাধারণ মানুষ বছরের পর বছর ধরে শহরের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন, যেখানে উৎসব মানেই ঝলমলে আলো, বড় বড় প্যান্ডেল, বিদেশি সাজসজ্জা আর লক্ষ লক্ষ টাকার বাজেট।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চেক্যা গ্রাম প্রমাণ করছে যে উৎসবের প্রাণশক্তি শুধুমাত্র টাকার অঙ্কে নয়, বরং মানুষের আন্তরিকতা, ভালোবাসা এবং ঐক্যে নিহিত।
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার সময় গোটা গ্রামই যেন এক অনন্য শহরে রূপান্তরিত হয়। ঘরের সামনে আলোর মালা, রঙিন সাজ, ঢাকের আওয়াজ আর উল্লাসে ভরে ওঠে প্রতিটি গলি।
শহরের নামকরা পুজো কমিটির ঝলমল আয়োজনকে যেন টক্কর দেয় এই গ্রামের মানুষ।
গ্রামের প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি মানুষ এই আয়োজনের অংশীদার হয়ে ওঠেন। তাদের কাছে এটি কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং সমাজের ঐক্যের বার্তা বহনকারী এক মহোৎসব।
উৎসবের দিনগুলোতে গ্রামের প্রতিটি মানুষই ব্যস্ত থাকে প্যান্ডেল সাজানো, আলোর কাজ করা, কিংবা অতিথিদের স্বাগত জানানোর কাজে।
শহরের মতো বাহুল্যপূর্ণ খরচ এখানে না থাকলেও মানুষের আন্তরিকতা এমন এক পরিবেশ তৈরি করে যেখানে দর্শনার্থীরাও অবাক হয়ে যান।
গ্রামবাসীদের মতে, উৎসব মানে শুধু শহরের অধিকার নয়, বরং গ্রামীণ হৃদয়ের উষ্ণতা আর একতার প্রকাশও হতে পারে। তাই চেক্যা গ্রাম আজ হয়ে উঠেছে পুরুলিয়ার সাংস্কৃতিক গর্ব।
✨ গ্রামের ঐক্যের প্রতীক পুজো
চেক্যা গ্রামের এই পুজোর অন্যতম বিশেষ দিক হলো, এটি কেবল একটি ক্লাবের আয়োজন নয়, বরং গোটা গ্রামের মিলিত প্রয়াস।
আয়োজক ‘ইয়ং স্টার মা লক্ষ্মী ক্লাব’ শুধুমাত্র পরিচালকের ভূমিকা পালন করে, আর গ্রামের প্রতিটি মানুষ যেন হয়ে ওঠেন এই উৎসবের প্রকৃত মালিক।
শহরের মতো চাঁদা তোলার চাপ বা বাধ্যবাধকতা এখানে নেই। গ্রামের মানুষ নিজেরা এগিয়ে এসে যা পারেন তাই অবদান রাখেন, আবার অনেকেই খাটুনি দিয়ে সময় ও শ্রম দেন।
এই পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রামে তৈরি হয় এক অভূতপূর্ব ঐক্যের আবহ। পুরো আয়োজন ঘিরে গ্রামবাসীদের মধ্যে তৈরি হয় সহযোগিতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক।
সকলে একসাথে সিদ্ধান্ত নেন কোন মঞ্চে কী হবে, কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে, কীভাবে গ্রামকে সাজানো হবে।
এতে গ্রামের তরুণ থেকে প্রবীণ, নারী থেকে শিশু—সবার অংশগ্রহণ থাকে সমানভাবে। পুজো চলাকালীন কারও মনে বিভেদ বা ভেদাভেদ থাকে না, বরং এই কয়েকদিন সবাই একসূত্রে বাঁধা পড়ে।
শহরের মানুষ যেখানে প্রায়ই অভিযোগ করেন উৎসবগুলো এখন বাণিজ্যিক হয়ে উঠছে, সেখানে চেক্যা গ্রামের এই পুজো যেন এক ভিন্ন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এটি একদিকে ধর্মীয় আচার, অন্যদিকে সামাজিক বন্ধনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
🎊 সপ্তম বর্ষে পা দিল চেক্যা গ্রাম লক্ষ্মীপূজা
চেক্যা গ্রামের লক্ষ্মীপূজা এ বছর সপ্তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এই পুজো শহরের পুজোগুলোর সমকক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে দর্শক টানার দিক দিয়ে।
প্রায় চার লক্ষ টাকার বাজেটে এই আয়োজন হলেও তা কোনোভাবেই চাপিয়ে দেওয়া নয়। আসল রহস্য লুকিয়ে আছে গ্রামের মহিলাদের ঝাঁপিতে।
তারা সারা বছর ধরে ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে রাখেন, যা শেষমেষ এই মহাউৎসবের মূল তহবিল হয়ে ওঠে।
এই প্রথা শুধুমাত্র অর্থ সঞ্চয়ের দিক থেকে নয়, বরং গ্রামের মহিলাদের আত্মনির্ভরতা এবং দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক হিসেবেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
গ্রামবাসীরা বলেন, “আমাদের মহিলারা যদি এই সঞ্চয় না করতেন, তবে এত বড় আয়োজন কখনো সম্ভব হতো না।”
তাঁদের এই ত্যাগ, পরিশ্রম ও দূরদর্শিতার ফলেই আজ চেক্যা গ্রাম আলোয় ঝলমল করছে।
শহরে অনেক সময় মানুষ বিরক্ত হন চাঁদার চাপে, যেখানে কারও উপর জোর করে টাকা তোলার প্রবণতা থাকে। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।
ঝাঁপির টাকা দিয়ে যে উৎসব হয়, তার প্রতিটি টাকাতেই থাকে পরিশ্রম, ভালোবাসা আর আন্তরিকতার ছাপ। আর সেই কারণেই চেক্যা গ্রাম আজ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
🎶 আলোকিত গ্রামে সাংস্কৃতিক উৎসব
কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার সময় চেক্যা গ্রাম শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি পরিণত হয় এক বিশাল সাংস্কৃতিক মঞ্চে।
প্রতিদিন আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। পালা-কীর্তন, যাত্রা, নাটক, সংগীত পরিবেশনা, এমনকি ঐতিহ্যবাহী লোকগানও দর্শকদের মাতিয়ে তোলে।
দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন শুধুমাত্র দেবীর দর্শন করতে নয়, এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করতে। গ্রামের উঠোন, মাঠ আর প্যান্ডেলগুলোতে জমে ওঠে এক অন্যরকম পরিবেশ।
অনুষ্ঠানগুলোতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তারা নাটকে অভিনয় করে, সংগীতে গলা মেলায়, আবার কেউবা নাচের আয়োজন করে।
এতে তাদের প্রতিভার প্রকাশ যেমন ঘটে, তেমনই আত্মবিশ্বাসও তৈরি হয়। প্রবীণরাও পালা-কীর্তন আর কীর্তন পরিবেশনার মাধ্যমে উৎসবকে ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করে রাখেন।
এমন উৎসবে দর্শনার্থীরা যেমন আনন্দ পান, তেমনই গ্রামের মানুষও গর্বিত হন।
শহরের ব্যস্ততা, যান্ত্রিক জীবন আর কোলাহল থেকে দূরে এই ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানুষকে নতুন করে মানবিকতার ছোঁয়া দেয়।
বলা যায়, এই পুজো গ্রামীণ সংস্কৃতির এক মহা-আড্ডায় পরিণত হয়।
🙏 আয়োজকদের বক্তব্য
চেক্যা গ্রামের আয়োজকদের বক্তব্যে উঠে আসে গ্রামবাসীর ঐক্যের প্রকৃত ছবি।
ক্লাব সভাপতি কাশিরাম কুমার বলেন, “আমাদের গ্রামের মানুষ একসঙ্গে মিলে এই পুজো করেন। চার দিন ধরে চলে পূজা, প্রতিদিনই আলাদা আনন্দ থাকে। কোনোদিন শুধুই ধর্মীয় আচার, আবার কোনোদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আসলে এ শুধু পুজো নয়, আমাদের মিলেমিশে থাকার এক উপলক্ষ।”
তাঁর মতে, এই পুজোর সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো গ্রামবাসীর ঐক্য।
অন্যদিকে ক্লাব সদস্য বদন কুমার জানান, “এটা শুধুই ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি আমাদের গ্রামের ভালোবাসা ও ঐক্যের প্রতীক। শহরে বড় বড় বাজেট থাকলেও সেখানে আন্তরিকতার অভাব দেখা যায়। কিন্তু আমাদের এখানে প্রতিটি কাজ ভালোবাসা দিয়ে করা হয়।”
এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, গ্রামের মানুষের কাছে এই পুজো ধর্মীয় সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়ে সামাজিক বন্ধনের এক মহাউৎসবে পরিণত হয়েছে।
আয়োজকদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাই এই পুজোকে আজ এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।
🌟 শহর নয় উৎসবের প্রাণ গ্রামে
চেক্যা গ্রামের লক্ষ্মীপূজা আজ প্রমাণ করছে যে উৎসবের প্রাণশক্তি শহরের ঝলমলে আলো বা বড় বাজেটে নয়, বরং মানুষের আন্তরিকতায়।
শহরে পুজো মানেই এখন কোটি কোটি টাকার বাজেট, প্রতিযোগিতা, মিডিয়ার চর্চা আর বিজ্ঞাপনের ঝলক।
কিন্তু চেক্যা গ্রামে যে পরিবেশ তৈরি হয়, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে নেই কোনও বাণিজ্যিকীকরণ, নেই অতিরিক্ত চাকচিক্যের মোড়ক। আছে কেবল ভালোবাসা, সহযোগিতা আর ঐক্যের গল্প।
আলোয় ঝলমল করা গ্রামটি যেন বলে দেয়—উৎসব মানে শহরের একচেটিয়া অধিকার নয়। আন্তরিকতা আর ঐক্য থাকলে গ্রামও হয়ে উঠতে পারে এক অসাধারণ উৎসবের কেন্দ্র।
পুরুলিয়ার মতো একটি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এভাবে ঝাঁপির টাকায় যে আয়োজন করেন, তা কেবল তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে জিইয়ে রাখে না, বরং অন্য গ্রামগুলির কাছেও এক প্রেরণা হয়ে ওঠে।
তাই বলা যায়, চেক্যা গ্রাম আজ উৎসবের এক নতুন সংজ্ঞা লিখছে।