পুরুলিয়ার কৃষিজীবীর প্রাণের উৎসব বাঁদনা পরব।
পুরুলিয়ার কৃষিজীবী মানুষ উদযাপন করছেন বাঁদনা পরব, যা তাদের জীবনের আনন্দ, কৃষি ও গবাদি পশুর প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।
অমাবস্যার রাত থেকে শুরু হয়ে তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত চলে এই উৎসব।
গো-গাভীর যত্ন, আলপনা, ঢোল-ধামসার সুর, ‘কাঁচি দিয়ারি’ ও অহিরা গীতের সঙ্গে গ্রামীণ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক বন্ধন ফুটে ওঠে।
বাঁদনা শুধু একটি উৎসব নয়, বরং গ্রামের মানুষের জীবনের গভীর বন্ধন ও মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় বহন করে। 🌾🐄🔥
কৃষিজীবী মানুষের অন্তরের বন্ধনে বাঁদনা পরবে মেতেছে পুরুলিয়া 🐄🌾
পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম এবং ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় একটি উৎসব যা দীর্ঘকাল ধরে তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
এই উৎসব হলো বাঁদনা। এটি মূলত গবাদি পশুদের বন্দনা বা পূজা কেন্দ্রীকৃত উৎসব, যা কুড়মি এবং অন্যান্য আদিবাসী সমাজের মানুষের কৃষিজীবন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
বছরের এই সময়ে কৃষকরা শুধুমাত্র কৃষি কাজেই ব্যস্ত থাকেন না, বরং তাদের অন্তরের আনন্দ, কৃতজ্ঞতা এবং উৎসবের উচ্ছ্বাসও প্রকাশ পায়।
বাঁদনা উৎসবটি মূলত আমন ধান তোলার আগে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে গো-গাভীর স্বাস্থ্য, শক্তি এবং উৎপাদনশীলতার জন্য বিশেষ পূজা ও যত্ন নেওয়া হয়।
এই উৎসবের নাম ‘বাঁদনা’ শব্দটি এসেছে কুড়মালি ভাষার ‘বঁদা’ থেকে, আবার কেউ কেউ মনে করেন এটি ‘বন্দনা’ বা ‘বন্ধন’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ।
উৎসবটি সাধারণত কার্তিক মাসের অমাবস্যার পূর্ববর্তী সময়ে শুরু হয় এবং তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত চলে।
এই সময়ে গ্রামের প্রতিটি মানুষ সক্রিয়ভাবে উৎসবে অংশগ্রহণ করেন, গরুদের যত্ন নেন, ঘর ও গোয়াল ঘর পরিষ্কার করেন এবং গ্রামের রাস্তা ও উঠোন আলপনা দিয়ে সাজিয়ে তোলেন।
এটি শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং গ্রামের মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন ও সংহতির প্রতীকও বটে। 🎶🌿
বাঁদনা পরবের প্রস্তুতি কৃষিজীবী মানুষের ব্যস্ততা 🌱🐄
বাঁদনা পরবের প্রকৃত আনন্দ এবং উৎসবের আবহ তৈরি হয় অমাবস্যার অন্তত পনেরো দিন আগে থেকেই। এই সময়ে গ্রামের প্রতিটি ঘর, উঠোন এবং গোয়াল ঘর ধুলো-ময়লা মুক্ত করা হয়।
মহিলারা মাটির প্রলেপ দিয়ে ঘর সাজান এবং রঙের মাধ্যমে ঘরকে নতুন রূপ দেন। পুরো গ্রাম যেন এক চমৎকার রঙিন উৎসবের প্রস্তুতি শুরু করে।
কৃষিজীবী মানুষ এই সময়ে গবাদি পশুদের যত্নে বিশেষ মনোযোগ দেন। গরুগুলোকে পর্যাপ্ত ঘাস খাওয়ানো হয়, তাদের গোয়াল ঘরে স্নান করানো হয় এবং শিং, খুর ও মাথায় তেল ও সিঁদুর দিয়ে সজ্জিত করা হয়।
এই প্রস্তুতি প্রায়শই পাঁচটি ধাপে বিভক্ত থাকে, যা হলো: তেল দেওয়া, ঘাওয়া, অমাবস্যা, গরয়াপূজা এবং গরু খুঁটা।
এই প্রতিটি ধাপই কৃষিজীবী মানুষের জীবনে আনন্দ, উৎসাহ এবং আত্মিক বন্ধনের প্রতিফলন।
মহিলারা ঘর সাজানোর পাশাপাশি গ্রামের রাস্তা ও উঠোন আলপনা দিয়ে সাজান, যা গ্রামের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য উভয়ই ফুটিয়ে তোলে।
এছাড়াও, এই প্রস্তুতির সময়ে গ্রামের যুবকরা ঢোল ও ধামসা বাজানোর প্রথা অনুশীলন করেন, যা উৎসবের আনন্দ আরও বাড়িয়ে তোলে।
গোয়াল ঘর এবং চারপাশের এলাকায় আতিথেয়তার ব্যবস্থা করা হয় যাতে গ্রামের মানুষ এবং অতিথিরা মিলিতভাবে উৎসবে অংশ নিতে পারে। 🐂💛
অমাবস্যার রাত গোঠপূজা ও কাঁচি দিয়ারি ✨🌙
অমাবস্যার রাত হলো বাঁদনা পরবের মূল আকর্ষণ, যা শুরু হয় গোঠপূজা দিয়ে। এই দিনে গ্রামে ছাদনদড়ি এবং বাঁধনদড়ির পুজা অনুষ্ঠিত হয়।
বিকেলে গ্রামের এক প্রান্তে গরু একত্র করা হয় এবং মাটিতে ডিম রাখা হয়। ঢোল, ধামসা বাজিয়ে গরুদের উত্তেজিত করা হয়, যাতে তারা ডিম ভাঙতে পারে।
যে গরু ডিম ভাঙে, তার মালিককে উপহার দেওয়া হয় – গামছা, লুঙ্গি বা ধুতি। সন্ধ্যার দিকে, গ্রামে বিভিন্ন জায়গায় শাল ও কাঁঠালের পাতায় চালের গুঁড়ি রাখা হয় এবং প্রদীপ জ্বালানো হয়।
এই রীতিকে বলা হয় ‘কাঁচি দিয়ারি’, যা গ্রামীণ জীবনের প্রাচীন বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। গ্রামে পাট কাঠি জ্বালানো হয় এবং ছেলেরা সেখানে উপস্থিত হয়ে আগুনে আনন্দ উদযাপন করেন।
এই জ্বলন্ত আগুন, গ্রামের মানুষের বিশ্বাস অনুসারে, সারাবছর চর্ম রোগ, খোস এবং দাদ থেকে মুক্তি দেয়।
এই রাত জুড়ে চলে ‘ইজোর-পিজোর’ খেলা, যেখানে গ্রামের মানুষ ঢোল, ধামসা বাজিয়ে এবং অহিরা গীত পরিবেশন করে গো-গাভীদের জাগিয়ে রাখে।
যারা গীত পরিবেশন করেন তাদের বলা হয় ‘ধিং ধাং বা ধাঁঙড়’। এই গীতগুলো লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিচিত।
ছোটনাগপুর অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস, অমাবস্যার রাতে মর্ত্যলোকের প্রতিটি গোয়াল বাড়িতে আসে বুড়াবাবা, অর্থাৎ শিব, এবং গরুদের অবস্থা দেখেন। 🌌🐄
গরয়া পূজা কৃষিজীবী মানুষের ধ্যান ও কৃতজ্ঞতা 🌾🙏
অমাবস্যার পরের দিন অনুষ্ঠিত হয় ‘গরয়া পূজা’, যা কৃষিজীবী মানুষের কৃতজ্ঞতা ও ধ্যানের প্রকাশ।
ভোরবেলা হয় ‘দাঁদুড় খেদা’ নাচ, যেখানে গ্রামের পুরাতন জিনিসপত্র যেমন ঝুড়ি, কুলো এবং টোকিয়া গ্রামের শেষ প্রান্তে নিয়ে ফেলে আগুনে জ্বালানো হয়।
গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করেন, এতে গ্রামের অমঙ্গল দূর হয়। কৃষকরা লাঙ্গল, জোয়াল এবং অন্যান্য চাষের যন্ত্রাংশ পরিষ্কার করে তুলসী তলার কাছে রাখেন।
ধানের শিষ দিয়ে গয়না তৈরি করে গরুর শিংয়ে পরানো হয়। মহিলারা বাড়ির উঠোনে আলপনা আঁকেন এবং দুপুরবেলা গোয়াল ঘরে শালুক পাতার উপর মাটির শিবলিঙ্গ রেখে পূজা করেন।
নৈবেদ্য হিসেবে বানানো হয় ‘গরয়া পিঠা’ এবং অনেকে মোরগ বলি দেন। এই রীতি প্রাচীন কালের কৃষিজীবী মানুষের কৃতজ্ঞতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের বন্ধনের প্রতিফলন।
বাঁদনা উৎসবের মাধ্যমে কৃষকরা শুধু তাদের ধান বা গবাদি পশুর জন্য নয়, বরং পুরো গ্রামের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্যও প্রার্থনা করেন। 🌾🌸
গরু খুঁটা উৎসবের চূড়ান্ত পর্ব 🐂🎶
বাঁদনা পরবের শেষ দিন হলো ‘গরু খুঁটা’, যা উৎসবের চূড়ান্ত এবং সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ পর্ব।
এই দিন, দু’দিন ধরে যত্ন নেওয়া গরুগুলো বিকালে গ্রামের খালি মাঠে সাজিয়ে একটি শক্ত খুঁটিতে বাঁধা হয়।
তারপর, মরা পশুর চামড়া ঘুরিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। ঢোল, ধামসা বাজানো হয় এবং অহিরা গীত পরিবেশন করা হয়।
গ্রামের মানুষ আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।
কাশিপুর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাত বলেন, “অতি প্রাচীন কাল থেকে কুড়মি সহ আদিবাসী সমাজ এই রীতি মেনে উৎসব পালন করে আসছে। রীতিনীতি আজও একইভাবে চলে আসছে।”
এই পর্ব কেবল একটি উৎসব নয়, বরং কৃষিজীবী মানুষের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং গবাদি পশুর প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। 🐂🔥
বাঁদনা ঐতিহ্য সংস্কৃতি এবং মানবিক বন্ধন 🌿💛
বাঁদনা উৎসব শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি কৃষিজীবী মানুষের জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এই উৎসবের মাধ্যমে তারা গবাদি পশুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়, কৃষিভিত্তিক সামাজিক সংহতি তৈরি করে এবং গ্রামের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় করে।
বিশ্বায়নের প্রভাব গ্রামীণ জীবনে পড়লেও পুরুলিয়ার কৃষিজীবী মানুষ তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং বন্ধনকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
বাঁদনা উৎসব প্রমাণ করে, প্রকৃতি, কৃষি এবং মানবজীবনের গভীর সম্পর্ক এখনও গ্রামীণ জীবনে জীবন্ত।
এটি শুধুমাত্র ঐতিহ্য নয়, বরং জীবনের আনন্দ, উৎসাহ এবং মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় বহন করে। 🎉🐄🌾
