রঙিন বাঁদনা উৎসব: পুরুলিয়ার মাটির দেওয়ালে জীবন্ত শিল্প।
পুরুলিয়ার বাঁদনা উৎসব কৃষিজীবি গ্রামের এক অনন্য সাংস্কৃতিক উদযাপন, যেখানে মহিলারা প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করে ঘর ও দেওয়ালকে সাজান।
দেওয়াল চিত্রে দেখা যায় পশুপাখি, গাছপালা, ফুল এবং গ্রামীণ জীবনের দৃশ্য। উঠোনে আলপনা বা ‘চোক্ পুরা’ দিয়ে নকশা করে উৎসবকে আরও রঙিন ও আনন্দময় করে তোলা হয়।
নবীন প্রজন্মও মা ও কাকিমাদের সঙ্গে অংশ নিয়ে এই লোকশিল্পকে ধরে রাখে। আধুনিকতার ছোঁয়া নেই এই উৎসবে, তাই প্রাচীন সংস্কৃতির সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য অমলিন থাকে।
দেওয়াল চিত্র ও আলপনার মিলনে বাঁদনা উৎসব হয়ে ওঠে প্রকৃতি, মানব সৃজনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত উদাহরণ।
এই উৎসব শুধু আনন্দ নয়, গ্রামের মানুষের পরিচয় ও সংস্কৃতির প্রতীক। 🌾🎨
আঙুল হয়ে ওঠে তুলি, প্রকৃতি সাজায় রঙ বাঁদনায় রঙিন পুরুলিয়া 🌾🎨
সাবেক মানভূম তথা বৃহত্তর ছোটনাগপুর অঞ্চলের কৃষিজীবি মানুষের জীবনে বাঁদনা উৎসব কেবল একটি সামাজিক অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি গ্রামীণ জীবন, কৃষিজীবী মানুষের সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক অপূর্ব উদযাপন।
বাঁদনা মূলত কৃষির সঙ্গে যুক্ত উৎসব, যা প্রাকৃতিক ঋতু ও ফসলের সমৃদ্ধিকে স্বাগত জানায়। উৎসবের মূল প্রাণ হলো অহিরা গীত, যা শ্রুতিমধুর সুরে কৃষিজীবী মানুষের জীবনচক্রকে ফুটিয়ে তোলে।
তবে শুধু গান নয়, বাঁদনার আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হলো মহিলাদের মাটির দেওয়ালে প্রাকৃতিক রঙে আঁকা চিত্র, যা গ্রামের প্রতিটি কোণা এবং ঘরকে শিল্পের ছোঁয়া দেয়।
দেওয়ালগুলোতে দেখা যায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য, পশুপাখি, গাছপালা, ফুল ও কৃষিজীবনের জীবনযাত্রা। মহিলাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় প্রতিটি দেওয়াল যেন প্রাণ ফিরে পায়।
আধুনিক যুগে এসে এই ঐতিহ্য অমলিন থাকায়, গ্রামীণ ঘরগুলো কেবল বসবাসের স্থান নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে তৈরি হওয়া চিত্রকর্মের ক্যানভাস।
দেওয়াল চিত্র এবং আলপনার সমন্বয় বাঁদনা উৎসবকে আরও জীবন্ত, রঙিন এবং আনন্দময় করে তোলে, যা দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হয়।
দেওয়াল চিত্র: প্রাকৃতিক রঙ ও নিপুণ শিল্পের মিলন 🌿🖌️
দেওয়াল চিত্রের ধারক ও বাহক মূলত মহিলারা, যারা বছরের পর বছর ধরে এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। দেওয়াল চিত্র তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি নিখুঁতভাবে মহিলাদের হাতে সম্পন্ন হয়।
তারা মাঠ এবং চাষের জমি থেকে চুনা মাটি, খড়ি মাটি, পলিমাটি সংগ্রহ করেন। সংগ্রহ করা মাটিতে গোবর মিশিয়ে দেওয়াল প্রস্তুত করা হয় এবং তারপর খড়ি মাটি দিয়ে একটি সাদা পৃষ্ঠ তৈরি করা হয়, যা পরে প্রাকৃতিক রঙের জন্য ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মহিলারা প্রাকৃতিক উপাদান যেমন কালো ছাই, লাল গেরু মাটি, হলুদ বনক মাটি বা আলয় মাটি, সাদা খড়ি মাটি, নীল বড়ি ও নীল জামা কাপড় থেকে প্রাপ্ত রঙ, সবুজ পাতার রঙ ইত্যাদি ব্যবহার করে দেওয়ালকে সাজান।
এই সব উপকরণ দিয়ে তারা পশুপাখি, গাছপালা, ফুল এবং কৃষিজীবনের নানা দৃশ্য আঁকেন। দেওয়ালে তুলির ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত; আঙুলের ডগায় কাপড় জড়িয়ে রঙ করা হয় যা মহিলাদের জন্য সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক।
এছাড়া শাল এবং খেজুরের ডাল ব্যবহার করে তুলির কাজ সম্পন্ন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় মাটির সঙ্গে মানব স্পর্শ মিলে দিয়ে দেওয়াল চিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে।
দেওয়াল চিত্র কেবল একটি শৈল্পিক প্রকাশ নয়, এটি গ্রামের মানুষের ইতিহাস, পরিচয় ও ঐতিহ্যকে ধারন করে।
প্রতিটি ঘর, প্রতিটি দেওয়াল দেখলেই বোঝা যায়, পরিবারের কোন গোত্রের মানুষ বসবাস করছে।
আলপনা: উঠোনের নান্দনিক সৌন্দর্য ✨
বাঁদনা উৎসব কেবল দেওয়ালের শিল্পকর্মেই সীমাবদ্ধ নয়; উঠোনে আলপনা বা ‘চোক্ পুরা’ সাজানোও উৎসবের অপর একটি আকর্ষণ।
আলপনা তৈরির জন্য পাইনা লতা, টেঁড়শ গাছ, গামার পাতা থেঁতলে এবং চালের গুঁড়া মিশিয়ে একটি প্রাকৃতিক পেস্ট তৈরি করা হয়।
এই পেস্ট দিয়ে উঠোনে জটিল ও নান্দনিক নকশা আঁকা হয়, যা গ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচায়ক।
আলপনা বিভিন্ন আকার, প্রতীক এবং প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়, যা দেখলে বোঝা যায় স্থানীয় সমাজের জীবনধারা ও সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ।
ডঃ ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাত, কাশিপুর মাইকেল মধুসূদন কলেজের অধ্যাপক, বলেছেন যে পূর্বে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াতের সময় দেওয়াল চিত্র ও আলপনা দেখে বোঝা যেত গ্রামের মানুষ কোন গোত্রের বা গোষ্ঠীর।
নগরায়নের ফলে আধুনিক মাটির ঘর কমে যাওয়ায় এই প্রাচীন শিল্প কমে আসছে, তাই বাঁদনা উৎসবের এই অংশ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
মহিলাদের হাতের প্রতিটি নকশা, রঙের ব্যবহার, এবং আঙ্গিক প্রমাণ করে যে এই লোকশিল্প শুধু সৌন্দর্য নয়, এটি গ্রামের মানুষের চেতনাকে সংরক্ষণ করছে।
বাঁদনা উৎসবে আধুনিকতার ছোঁয়া নেই 🏡🌱
সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ সনৎ কুমার মাহাত বলেন,
“তুলি থেকে রং সবকিছু মহিলারাই তৈরি করেন। রাসায়নিক কোনো কিছুই এই পরবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। বাঁদনা উৎসবের নিজস্বতা এটাই।”
মহিলারা বছরে একবার বাঁদনা উৎসবের সময় পুরো গ্রামকে প্রাকৃতিক রঙ ও তাদের সৃজনশীলতা দিয়ে সাজান।
রাসায়নিক রঙ ব্যবহার না করেও তারা যে কেমন করে ঘর এবং দেওয়ালকে সাজায়, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
এই প্রক্রিয়ায় তারা শুধু একটি ঘর বা দেওয়াল সাজাচ্ছেন না, বরং গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতি, এবং তাদের সৃজনশীলতার মধ্যে এক অপূর্ব মিলন ঘটাচ্ছেন।
দেওয়াল চিত্র এবং আলপনার সৌন্দর্য দেখলে বোঝা যায় যে আধুনিকতার ছোঁয়া এখানে কোনোভাবেই প্রবেশ করতে পারেনি, বরং এই উৎসব আজও গ্রামীণ সংস্কৃতিকে অমলিন রাখছে।
নবীন প্রজন্মের উৎসাহ ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা 👩🎨🌸
বামুনডিহা গ্রামের সুগা মাহাত এবং তুম্বাঝালদা গ্রামের মৌসুমী মাহাত বলেন,
“সারা বছর ধরে আমরা বাঁদনা উৎসবের অপেক্ষায় থাকি। এই সময়ই ঘর সাজাই। নবীন প্রজন্মও এই শিল্পকে ধরে রাখতে চায়।”
নবম শ্রেণীর চুমকি মাহাত এবং অষ্টম শ্রেণীর সোনালী মাহাত জানান,
“আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের পরিচয়। তাই বাঁদনা পরব এলেই মা, কাকিমাদের সঙ্গে ঘর সাজাই। আমরা কোনো খামতি রাখি না।”
নবীন প্রজন্মের এই অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে বাঁদনা উৎসব কেবল পুরাতন স্মৃতি নয়, এটি একটি জীবন্ত সংস্কৃতি, যা আগামীর জন্যও সংরক্ষিত।
তারা মহিলাদের সঙ্গে কাজ করে শিখছে, প্রতিটি নকশা ও চিত্র আঁকার কৌশল জানতে পারছে এবং তাদের নিজস্বতার সঙ্গে ঐতিহ্যকে মিশিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ সমাজের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ নিশ্চিত হয়।
দেওয়াল চিত্র ও আলপনার মিলিত সৌন্দর্য 🎨🏡
বাঁদনা উৎসবে দেওয়াল চিত্র ও আলপনার মিলনে যে দৃশ্য সৃষ্টি হয়, তা সত্যিই চোখে পড়ার মতো।
দেওয়ালে চিরাচরিত নকশা, পশুপাখি, ফুল ও গাছপালা এবং উঠোনে নান্দনিক আলপনা মিলিয়ে এক ধরণের রঙিন ও জীবন্ত দৃশ্য তৈরি হয়।
মহিলাদের নিপুণ হাতের কাজ, প্রাকৃতিক রঙের ছোঁয়া, এবং নবীন প্রজন্মের অংশগ্রহণ এই উৎসবকে শুধুই আনন্দের নয়, বরং সংস্কৃতির পরিচয় বহনকারী উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি উঠোনে দেখা যায় গ্রামীণ জীবনের সাদামাটা অথচ গভীর সৌন্দর্য।
উপসংহার 🌟
বাঁদনা উৎসব প্রমাণ করে যে, প্রাচীন লোকশিল্প ও গ্রামীণ সংস্কৃতি আধুনিক যুগেও বেঁচে থাকতে পারে, যদি মহিলাদের দক্ষতা এবং নবীন প্রজন্মের আগ্রহ থাকে।
দেওয়াল চিত্র, আলপনা, প্রাকৃতিক রঙ এবং মানুষের স্পর্শ মিলিয়ে এই উৎসবকে করে তোলে রঙিন, জীবন্ত এবং সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ উদাহরণ।
পুরুলিয়ার গ্রামীণ ঘরগুলো শুধুই বসবাসের স্থান নয়, বরং প্রকৃতি ও মানব সৃজনশীলতার মিলনের এক অমলিন চিত্রকর্মের ক্যানভাস।
বাঁদনা উৎসবের এই জীবন্ত শিল্প ও ঐতিহ্য দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হয় এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। 🌾❤️