পুরুলিয়ায় একাদশীতে রাবণ দহন উৎসব।
পুরুলিয়ায় দুর্গাপূজোর পরে শুধু বিজয়াদশমীতেই নয়, একাদশীতেও পালিত হয় ঐতিহ্যবাহী রাবণ দহন উৎসব 🎇।
ঝালদা, জয়পুর, বাঘমুন্ডি ও বলরামপুরের মাঠে হাজারো মানুষের জমায়েতে অনুষ্ঠিত হয় এই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন।
বিরূপ আবহাওয়া, ভিড় ও কোলাহল সত্ত্বেও মানুষের উৎসাহকে দমাতে পারেনি কিছুই। আতশবাজির ঝলক, মেলা, সংগীত আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মিলে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে।
এ বছরের বিশেষত্ব ছিল শহিদ মনীশরঞ্জন মিশ্রকে উৎসর্গকৃত রাবণ দহন, যা আবেগঘন মাত্রা যোগ করেছে।
প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়। এই ঐতিহ্য কেবল বিনোদন নয়, বরং শুভ শক্তির জয় ও অশুভের বিনাশের প্রতীক।
একাদশীর রাবণ দহন প্রমাণ করে পুরুলিয়ার সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধনের গভীরতা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শুভ শক্তির বিশ্বাসকে জিইয়ে রাখে।
📰 পুরুলিয়ায় একাদশীতেও রাবণ দহন: ঐতিহ্য, আবেগ ও সামাজিক বার্তা
পুরুলিয়া জেলা সবসময়ই তার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, লোকঐতিহ্য আর অসাধারণ উৎসব–আয়োজনে বিখ্যাত।
দুর্গাপুজোর শেষে গোটা ভারতবর্ষের মতোই এখানে বিজয়াদশমীতে রাবণ দহন হয়। তবে পুরুলিয়ার বিশেষত্ব হলো, এখানে একাদশীতেও রাবণ দহন অনুষ্ঠিত হয়।
শুক্রবার একাদশীর দিনে ঝালদা, জয়পুর, বাঘমুন্ডি এবং বলরামপুরের বিভিন্ন মাঠে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হলো এই উৎসব। হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমালেন এই অনন্য আয়োজনে।
বিশেষ করে ঝালদার হাটতলা ময়দান, জয়পুরের বারবেন্দা, বাঘমুন্ডির লহরিয়া এবং বলরামপুরের ডাভা মাঠ হয়ে উঠল উৎসবমুখর।
👉 এই আয়োজন শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয় যে শুভ শক্তি সর্বদা অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে।
🌟 রাবণ দহনের ঐতিহ্য
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিজয়াদশমীতে রাবণ দহন একটি পরিচিত প্রথা। এটি আসলে রামায়ণের কাহিনির প্রতীকী পুনরাবৃত্তি, যেখানে ভগবান রাম রাবণকে বধ করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন।
এই প্রতীকী ঘটনার মধ্য দিয়েই সমাজকে শিক্ষা দেওয়া হয়—অন্যায় ও অসত্য যত বড় হোক না কেন, সত্য ও ন্যায় সর্বদা বিজয়ী।
পুরুলিয়ায় এই প্রথা আরও বিশেষ। এখানকার মানুষ দশমী তো বটেই, একাদশীতেও সমান জাঁকজমকের সঙ্গে রাবণ দহন করে থাকেন।
স্থানীয়দের বিশ্বাস, একাদশীর রাবণ দহন শুভ শক্তিকে আরও দৃঢ়ভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। এটি কেবল ধর্মীয় বা পৌরাণিক নয়, বরং সামাজিক ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
শিশুরা থেকে প্রবীণ পর্যন্ত সবাই এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করেন। বাড়ির মহিলারা বিশেষ খাবার রান্না করেন, পুরুষেরা উৎসবের আয়োজন করেন আর কিশোর–কিশোরীরা আনন্দে ভরিয়ে তোলে মাঠ–ময়দান।
রাবণের প্রতীকী দহন মানে কেবল দুষ্টের বিনাশ নয়, বরং সমাজে আশার আলো ছড়ানো। এভাবেই পুরুলিয়ার একাদশীর রাবণ দহন হয়ে উঠেছে অশুভের বিনাশ আর শুভ শক্তির জয়ের ঐতিহ্যবাহী প্রতীক।
🎇 ঝালদার জমকালো আয়োজন
শুক্রবার একাদশীর রাতে ঝালদার হাটতলা ময়দানে নেমে আসে মানুষের ঢল। হাজারো মানুষের সমাগমে মাঠ পরিণত হয়েছিল রঙিন মেলায়।
আয়োজনের নেতৃত্ব দেয় ঝালদা আনন্দবাজার সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটি। প্রচণ্ড ভিড় থাকা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানটি সুসংগঠিতভাবে পরিচালনা করা হয়।
প্রধান আকর্ষণ ছিল বিশালাকার রাবণ পুতুল দহন। আগুনে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা রাবণের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ভরে ওঠে আতশবাজির ঝলকানিতে।
শিশু থেকে বৃদ্ধ—সকলেই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন সেই মুহূর্ত। আতশবাজির রঙিন আলোতে ঝালদার আকাশ যেন অন্য এক জগতে রূপ নেয়।
যদিও দিনভর আবহাওয়া ছিল বিরূপ, মেঘলা আকাশ ও বৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল প্রবল, তবুও উৎসবপ্রেমীদের ভিড়ে কোনো ভাটা পড়েনি।
মানুষের উচ্ছ্বাসই প্রমাণ করে দেয়—ঐতিহ্য আর আবেগের কাছে আবহাওয়া কোনো বাধা হতে পারে না।
শুধু বিনোদন নয়, এই আয়োজনকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে হাটবাজার। স্থানীয় বিক্রেতারা খাবার, খেলনা, আতশবাজি বিক্রি করে ভালো ব্যবসা করেন।
ফলে রাবণ দহন উৎসব কেবল সাংস্কৃতিক নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও এলাকাবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
🏞️ অন্যান্য অঞ্চলের উৎসব
পুরুলিয়ার বিশেষত্ব হলো, একাদশীর রাবণ দহন শুধু ঝালদাতেই সীমাবদ্ধ নয়। জেলাজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় সমান উৎসাহে পালিত হয় এই উৎসব।
জয়পুরের বারবেন্দা, বাঘমুন্ডির লহরিয়া এবং বলরামপুরের ডাভা মাঠেও অনুষ্ঠিত হয় রাবণ দহন।
প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকলেও সবার উদ্দেশ্য এক—শুভ শক্তির বিজয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষ থেকে শহরের মানুষ—সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে অংশ নেন এই আয়োজনে। এ যেন গোটা জেলার ঐক্যের প্রতীক।
জয়পুরে রঙিন মেলা বসে, বাঘমুন্ডিতে লোকসংগীত ও নৃত্যের আসর জমে ওঠে, আর বলরামপুরে স্থানীয় যুবসমাজ নেতৃত্ব দেয় উৎসবে। এর ফলে প্রতিটি অঞ্চল নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরার সুযোগ পায়।
উৎসবকে ঘিরে পরিবার–পরিজনদের পুনর্মিলন ঘটে। বাইরে থাকা মানুষজনও বিশেষভাবে বাড়ি ফেরেন এই দিনগুলিতে।
একাদশীর রাবণ দহন তাই শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি সমাজকে একত্রিত করার সেতুবন্ধন।
🕊️ শহিদ স্মরণে উৎসব
এই বছরের ঝালদার রাবণ দহন উৎসব পেয়েছে এক বিশেষ মাত্রা। কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় শহিদ হয়েছিলেন ঝালদার সন্তান মনীশরঞ্জন মিশ্র। তাঁকে উৎসর্গ করা হয় এই বছরের রাবণ দহন।
শহিদের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আবেগের ঢেউ আছড়ে পড়ে। উপস্থিত দর্শনার্থীরা শহিদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
অনেকেই চোখের জলে ভেসে ওঠেন, আবার কেউ কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে শহিদকে শ্রদ্ধা জানান।
এই উদ্যোগের মাধ্যমে উৎসব পেয়েছে এক গভীর তাৎপর্য। রাবণের প্রতীকী দহন যেমন অশুভ শক্তির বিনাশ, তেমনি শহিদের স্মরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় দেশের জন্য আত্মত্যাগই সর্বোচ্চ মহৎ কাজ।
স্থানীয় মানুষ মনে করেন, এই উদ্যোগ আগামী প্রজন্মের কাছে দেশপ্রেমের অনন্য বার্তা পৌঁছে দেবে।
উৎসব মানেই কেবল আনন্দ নয়, তার মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ আর জাতীয় চেতনা জড়িয়ে থাকে—এই সত্য আবারও সামনে এসেছে।
👮 নিরাপত্তার কঠোর ব্যবস্থা
হাজারো মানুষের জমায়েতকে ঘিরে নিরাপত্তা ছিল প্রশাসনের কাছে বড় দায়িত্ব। ঝালদা থানার পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসন শুরু থেকেই কঠোর নজরদারি চালায়।
মাঠের চারপাশে স্থাপন করা হয় পুলিশ পিকেট। উৎসব চলাকালীন মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত বাহিনী।
ভিড় নিয়ন্ত্রণে ছিল স্বেচ্ছাসেবী দল, যারা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করে। জরুরি পরিস্থিতির জন্য ছিল অ্যাম্বুলেন্স ও অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর উপস্থিতি। উৎসবের প্রতিটি মুহূর্তেই নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
উপস্থিত ছিলেন ঝালদা পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিজয় কান্দু, স্থানীয় অগ্নিনির্বাপক আধিকারিক এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। তাঁদের উপস্থিতি উৎসবে আরও মর্যাদা যোগ করে।
নিরাপত্তার এই সঠিক ব্যবস্থা না থাকলে এত বড় আয়োজন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হতো না। দর্শনার্থীরাও নিশ্চিন্তে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পেরেছেন।
এ থেকেই বোঝা যায়—সুষ্ঠু আয়োজন মানেই শুধু সাংস্কৃতিক নয়, নিরাপত্তার দিক থেকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা জরুরি।
🗣️ কমিটি ও বাসিন্দাদের বক্তব্য
উৎসবকে ঘিরে সাধারণ মানুষের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। ঝালদা আনন্দবাজার সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির সদস্য মুকেশ দাস জানান,
“প্রতি বছর ঝালদা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এই রাবণ দহনের জন্য। শুধু বিনোদন নয়, এর মধ্যে একটা সামাজিক বার্তাও আছে—অশুভের বিনাশ আর শুভ শক্তির জয়।”
স্থানীয় বাসিন্দা ময়ূরাক্ষী দাস বলেন,
“এটি কেবলমাত্র একটি ঐতিহ্য নয়, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শুভ শক্তির বিশ্বাসকে জিইয়ে রাখার এক প্রতীকী উৎসব।”
এছাড়া অনেক স্থানীয় ব্যবসায়ীও জানান, এই উৎসব তাঁদের ব্যবসায়িক দিক থেকেও লাভজনক। খাবারের দোকান, খেলনার স্টল, আতশবাজির দোকান—সবাই প্রচুর বিক্রি করেন।
সাধারণ মানুষ মনে করেন, এই আয়োজন শুধু বিনোদনের সুযোগ নয়, বরং সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার একটি প্ল্যাটফর্ম।
❤️ সমাজে রাবণ দহনের বার্তা
রাবণ দহন উৎসবের মূল শিক্ষা হলো—অশুভ যত প্রবল হোক না কেন, শুভ শক্তিই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। আজকের সমাজেও এই বার্তা সমানভাবে প্রযোজ্য।
-
দুর্নীতি, হিংসা, অসত্য, লোভ—এ সবই আজকের রাবণ।
-
আর সততা, ন্যায়, মানবতা হলো আজকের রাম।
রাবণের প্রতীকী দহন তাই আমাদের শেখায়—সমাজের অন্ধকার দূর করতে হলে একত্রিত হয়ে শুভ শক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
পুরুলিয়ার একাদশীর রাবণ দহন কেবল একটি স্থানীয় উৎসব নয়, বরং এটি সমগ্র সমাজের জন্য এক নৈতিক শিক্ষা। এখানে মিলেমিশে যায় ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ আর দেশপ্রেম।
এভাবেই এই উৎসব বারবার মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে উৎসব মানে কেবল আনন্দ নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শিক্ষা, দায়িত্ব ও সামাজিক বার্তা।
📌 উপসংহার
পুরুলিয়ার একাদশীর রাবণ দহন উৎসব প্রমাণ করে—ঐতিহ্য, আবেগ ও সামাজিক বার্তা মিলেমিশে একত্রিত হলে একটি আয়োজন কতটা তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে।
ঝালদা, জয়পুর, বাঘমুন্ডি ও বলরামপুরের মানুষের জন্য এই উৎসব কেবল বিনোদন নয়, বরং সামাজিক সংহতির প্রতীক।
আতশবাজি, মেলা, মানুষের ভিড়—সব কিছুর মাঝেই লুকিয়ে থাকে এক গভীর শিক্ষা। অশুভ যত শক্তিশালীই হোক না কেন, শুভ শক্তিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়।
শহিদের স্মরণ আবারও আমাদের মনে করিয়ে দেয় দেশপ্রেম আর আত্মত্যাগের গুরুত্ব। পুরুলিয়ার এই ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলতে থাকবে।
আর প্রতিবারই একাদশীর রাতে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা রাবণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নতুন করে বিশ্বাস করবে—শুভ শক্তির আলো কখনও নিভে যেতে পারে না।