ধনতেরাস ২০২৫: ঝাঁটা কেনা, সোনা-রূপোর গল্প ও পূজার রহস্য।
ধনতেরাস হল বাঙালির জীবনে আলোর উৎসব ও সমৃদ্ধির প্রতীক। এদিন নতুন ঝাঁটা আনা, সোনা-রূপোর পূজা, কুবের ও ধন্বন্তরীকে প্রদীপ জ্বালানো হয়।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই দিন অকালমৃত্যু রোধ ও ভাগ্য বৃদ্ধি করে। ধনতেরাস শুধুই ধনলাভ নয়, বরং সুস্থতা, আনন্দ ও জীবনের আলোর শিক্ষা দেয়।
কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীতে উদযাপিত এই উৎসবে পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে পূজা, মিষ্টি বিতরণ ও ঘরের সাজসজ্জা করে আনন্দ ভাগাভাগি করেন।
সোনা ও রূপোর মাধ্যমে ভাগ্য বৃদ্ধি, ঝাঁটার মাধ্যমে সৌভাগ্য প্রবাহ এবং প্রদীপের আলোতে জীবন আলোকিত হয়।
ধনতেরাস ২০২৫ সোনা রূপোর পূজা ও ঝাঁটার প্রথা 🪔✨
ধনতেরাস আজকের দিনে বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিগত কয়েক দশক আগে, বাঙালির ঘরে এই উৎসবের উপস্থিতি তেমনভাবে লক্ষ্য করা যেত না।
তখন দীপাবলি মানেই আলোর উৎসব, কালীপুজো এবং আতসবাজি। তবুও মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাবে, টেলিভিশন বিজ্ঞাপন, এবং উত্তর ভারতের প্রভাব বাংলার ঘরে ঘরে ধনতেরাসের আগমন ঘটিয়েছে।
বর্তমানে, কার্তিক মাসে ধনতেরাসের আগমন বাঙালির জন্য সমৃদ্ধি, স্বাস্থ্য এবং ভাগ্য বৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
সোনার দোকানগুলো ভিড়ে পূর্ণ হয়, রুপোর হাঁড়ি-বাটি কেনার ধুম লেগে যায়, এবং ঘর-বাড়ি সাজানো হয় আলো দিয়ে।
এই উৎসব কেবল ধনলাভের জন্য নয়, বরং মানুষের জীবনে সুস্থতা, শান্তি এবং আলোর প্রতীক হিসেবে উদযাপন করা হয়।
ধনতেরাসের ইতিহাস ও সময়কাল 📜
দীপাবলি পাঁচ দিনের উৎসব, যার প্রথম দিনটি কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে পড়ে। এই দিনটিকে ধন ত্রয়োদশী বা ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী বলা হয়।
স্থানভেদে একে ধনতেরাস নামেও অভিহিত করা হয়। এই দিনটি বিশেষভাবে ধন বৃদ্ধি ও শুভতা আনার জন্য পরিচিত। বাঙালিরা এদিন সোনা, রূপা এবং নতুন ধাতব সামগ্রী কিনে ঘরে রাখেন।
তবে ধনতেরাস শুধুই ধনলাভের উৎসব নয়। গৃহের বহির্ভাগে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও পূজার মাধ্যমে অপমৃত্যু নিবারণ এবং সাফল্য কামনা করা হয়।
পুরাণ অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের সময় অমৃতকলস হাতে ধন্বন্তরী আবির্ভূত হন। সমুদ্র মন্থনের ফলে চৌদ্দ রত্নের সৃষ্টি হয়—যেমন লক্ষ্মী, কামধেনু, ঐরাবত, কৌস্তুভ মণি, কল্পবৃক্ষ, চন্দ্র, পারিজাত, শঙ্খ, বারুণী, অপ্সরা, ধন্বন্তরী, অমৃত, হলাহল এবং শঙ্খনিধি-পদ্মনিধি।
ধন্বন্তরীকে বৈদ্য, বনস্পতি ও ওষুধের অধিপতি হিসেবে মানা হয়, যার আশীর্বাদে রোগমুক্তি এবং সুস্থ জীবন লাভ হয়।
এই দিনটি দেবী লক্ষ্মী, ভগবান গণেশ এবং ধনদেব কুবেরের পূজার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
ধনতেরাস ও চিকিৎসা জ্ঞান 🏥
ধনতেরাস শুধুই সমৃদ্ধি বা ধনলাভের উৎসব নয়, এটি আয়ুর্বেদ ও চিকিৎসা জ্ঞানের সাথে গভীরভাবে জড়িত।
ধন্বন্তরীর বংশে জন্ম নেন চিকিৎসার জনক দিবোদাস, যিনি মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র সুশ্রুতের গুরু ছিলেন।
সুশ্রুত রচনা করেন ‘সুশ্রুত সংহিতা’, যা আয়ুর্বেদের এক মহাগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। ধন্বন্তরীর আশীর্বাদে রোগের বিনাশ এবং সুস্থ জীবন পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করা হয়।
ভারত সরকার ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ধনতেরাসকে জাতীয় আয়ুর্বেদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
সুতরাং, ধনতেরাস শুধুই অর্থের বা সম্পদের উৎসব নয়, বরং এটি আমাদের স্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবনের প্রতীক।
এদিনের পূজা এবং প্রথার মাধ্যমে মানুষ প্রাচীন আয়ুর্বেদিক জ্ঞানকে সম্মান জানায় এবং রোগমুক্তি কামনা করে।
ধনতেরাসের পৌরাণিক কাহিনি 📖
পৌরাণিক কাহিনির আলোকে ধনতেরাসের গুরুত্ব আরও গভীর হয়। এক রাজকন্যার প্রেমিক রাজপুত্রের ওপর ছিল অভিশাপ—বিয়ের চতুর্থ দিনেই তাঁর মৃত্যু হবে।
নববধূ জানতেন স্বামীর প্রাণ রক্ষা করার জন্য তাকে দেবদ্বয়ের আশীর্বাদ নিতে হবে। তিনি গণেশ ও লক্ষ্মীর পূজা করে দিক নির্দেশ পান।
পরবর্তীতে যমরাজ রাজপ্রাসাদে পৌঁছাতে না পেরে সোনা-রূপোর আলোতে ভ্রান্ত হন এবং ফিরে যান। সেই দিনটি পরবর্তীকালে ধনতেরাস নামে পরিচিত হয়।
আরও এক বিশ্বাস অনুযায়ী, লক্ষ্মীদেবী একবার মুনি দুর্বাসার অভিশাপে স্বর্গ ত্যাগ করে সমুদ্রের আশ্রয় নেন।
সমুদ্র মন্থনের সময় তিনি ফিরে আসেন, মা কালী অশুভ শক্তি বিনাশ করেন, এবং মা লক্ষ্মী আনে শ্রীবৃদ্ধি। এভাবেই দীপাবলি পূর্ণতা পায় এবং ধনতেরাসের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে।
ধনতেরাসের বিশেষ প্রথা: ঝাঁটা কেনা 🧹
ধনতেরাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রথা হলো নতুন ঝাড়ু আনা। তবে নতুন ঝাড়ু ব্যবহারের আগে অবশ্যই পুরনো ঝাড়ুর পূজা করা হয়।
এরপর সিঁদুর এবং আতপ চাল দিয়ে নতুন ঝাড়ুর আরম্ভ হয়। এই প্রথার অর্থ হলো ঘরে সুখ, সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্য প্রবাহিত হওয়া।
নতুন ঝাড়ু আনা শুধু ঘরের পরিচ্ছন্নতার প্রতীক নয়, বরং এটি পরিবারে ধন, সুখ এবং শান্তির আগমন নিশ্চিত করে। বাঙালি পরিবারে এই প্রচলন আজও দৃঢ়ভাবে বিদ্যমান।
এদিন পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে ঝাড়ুর পূজা করেন, পরস্পরের মঙ্গল কামনা করেন এবং ঘরে আলোর উৎসব উদযাপন করেন।
সোনা ও রূপোর মাহাত্ম্য 💰
ধনতেরাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সোনা ও রূপোর পূজা ও কেনা। এদিন কেনা সোনা বা রূপো কেবল ধনলাভের জন্য নয়, এটি সুখ, সমৃদ্ধি এবং পরিবারের মঙ্গল কামনার প্রতীক।
পরিবারের সদস্যরা নতুন ধাতব সামগ্রী কিনে ঘরে রাখেন এবং পূজা করে তাদের সৌভাগ্য বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করেন।
অনেকের বিশ্বাস, এদিন সোনা বা রূপো কেনার মাধ্যমে ভাগ্য উন্নত হয় এবং জীবনে আর্থিক স্থিতিশীলতা আসে।
বিশেষ করে এই দিনে সোনা-রূপোর বাজারে ভিড় থাকে, এবং দোকানগুলো আলোর ঝলকে সাজানো থাকে।
এটি কেবল ধনলাভ নয়, বরং আলোর উৎসব ও আনন্দের প্রতীক হিসেবেও ধনতেরাসকে সমৃদ্ধ করে।
ধনতেরাসের পূজা প্রথা 🕯️
সন্ধ্যায় উত্তর দিকে কুবের এবং ধন্বন্তরীকে প্রতিষ্ঠা করে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। কুবেরকে সাদা মিষ্টি, ধন্বন্তরীকে হলুদ মিষ্টি নিবেদন করা হয়।
পূজা শুরু হয় “ওম হ্রীম কুবেরায় নমঃ” জপ দিয়ে, এরপর ধন্বন্তরী স্তোত্র পাঠ করা হয়। প্রসাদ গ্রহণের মাধ্যমে এই পূজা সমাপ্ত হয়।
দীপাবলির দিনে কুবেরকে সম্পদের স্থানে এবং ধন্বন্তরীকে পূজাস্থানে প্রতিষ্ঠা করার প্রথা এখনও বিদ্যমান।
এভাবে ধনতেরাসের পূজা কেবল সমৃদ্ধি নয়, বরং পরিবারের সুরক্ষা, সুস্থতা এবং সুখ নিশ্চিত করে।
ধনতেরাসের মূল শিক্ষা 🌟
ধন, দীপ এবং জীবনের মঙ্গলকামনায় ভাসে ধনতেরাস। সোনা বা রূপো কেনার বাইরে, এদিনের আসল তাৎপর্য হলো অমৃতের সন্ধান, রোগমুক্তি এবং জীবনের আলোতে পূজা।
এই উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃত ধন কেবল অর্থ নয়, বরং সুস্থতা, শান্তি এবং আলোর মধ্যে নিহিত।
পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়ে পূজা করেন, আনন্দ ভাগাভাগি করেন এবং একে অপরের মঙ্গল কামনা করেন।
ধনতেরাস কেবল এক উৎসব নয়, এটি আমাদের জীবনকে আলোকিত করার এক চিরন্তন বার্তা। 🪔💛